★ সিজার/অপারেশনের জন্য বাধ্যতামূলক নারকোটিক অনুমোদন নেই ক্লিনিকগুলোর। ★ ডেঙ্গু রোগীদের জন্যেও নেই কোন চিকিৎসা। ★পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই দেদাড়ছে চলছে হাসপাতাল গুলো। ★নামে ক্লিনিক হলেও রোগী ভর্তির ক্ষত্রে শুধু গর্ভবতীদেরই চিকিৎসা প্রদান। ★ চলতি বছরে প্রায় একত্রিশ শত ক্লিনিক হাসপাতালের অনুমোদন। ★লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে বিধিমালা লঙ্ঘনের দায় স্বীকার করেছেন সাবেক ডাইরেক্টর। ★বিতর্কিত লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখবেন বর্তমান এডিশনাল ডিরেক্টর।
একটি হাসপাতাল, ক্লিনিকে প্রয়োজনীয় সকল চিকিৎসা সেবা দেয়ার বিধান থাকলেও এক অনুসন্ধানে দেখাগেছে দেশব্যাপী প্রায় এক হাজারের অধিক সংখ্যক প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতাল শুধুমাত্র সিজারের মাধ্যমে নবজাতকের আগমন নিশ্চিত করে চলছে। সরেজমিনে দেখা যায় হাসপাতাল গুলোর কোন ওয়ার্ডেই অন্য উপসর্গের রোগী দেখা যাচ্ছে না, যদিও শুধুমাত্র সিজার করে বাচ্চা ডেলিভারির জন্য কোন হাসপাতাল কে লাইসেন্স দেয়া হয় না। এতে হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন দেয়ার শর্তের চরম লঙ্ঘন। বিগত বছর গুলোয় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে গেলেও সেইসব ক্লিনিক ও হাসপাতালে ভর্তি নিচ্ছে না ডেঙ্গু আক্রান্তদের। ফলে চাপ বাড়ছে সরকারি হাসপাতাল গুলোতে। এসকল ক্লিনিক ও হাসপাতাল গুলো যেনো সরকারি মাতৃসদন হাসপাতালের আদলে বেসরকারি মাতৃসদনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। গর্ভবতীদের বিভিন্ন ভয় দেখিয়ে করে চলছে সিজার ডেলিভারিতে বাধ্য। সিজার করা হলেও এসকল ক্লিনিক ও হাসপাতালে নেই কোন বর্জ্য নিষ্কাশন বা অপসারনের ব্যাবস্থা, নেই লোকাল এনেস্থিসিয়া পরিমাপের জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্তিপক্ষের ছাড়পত্র। নোংরা পরিবেশে করে চলছে সিজারের মতো গুরতর অপারেশন, এসব হাসপাতালের বেশিরভাগই কোন ভাড়া করা ভবন অথবা মার্কেটে। নেই তাদের পরিবেশ অধিদপ্তরের বাধ্যতামূলক ছাড়পত্র। নেই এ্যাম্বুলেন্স, নেই এম্বুলেন্স রাখার জায়গা। নেই নবজাতকের জন্য এনআইসিইউ আর গর্ভবতীর জন্য কোন অবজারভেশন রুম। যার দরুন ডেলিভারির পর মা এবং শিশুরা ব্যাপক স্বাস্থ্য ঝুকিতে পড়ছে, মৃত্যু বড়ন ও করছে অনেক মা ও তার নবজাতক শিশু। এসকল হাসপাতাল ও ক্লিনিক গুলো কে কেনো অনুমোদন দিয়ে রোগীদের স্বাস্থ্য ঝুকিতে ফেলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ প্রশ্ন এখন সকলের। ১৯৮২ সালের মেডিকেল এন্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস এন্ড ল্যাবরেটরিস অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানোর সুযোগ নেই। বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনার ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র বা অবস্থানগত ছাড়পত্র ব্যতীত আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিবন্ধন পাওয়ার সুযোগও নেই। এবার সেই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করে নিজেরাই আইনের শর্ত ভঙ্গ করে হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে লাইসেন্স দিয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরিবেশ ছাড়পত্র ও নারকোটিক পারমিট পাবার সম্ভাবনা না থাকলেও শুধুমাত্র আবদনের রশিদ দেখেই লাইসেন্স দিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। সম্প্রতি পরিবেশ ছাড়পত্র, নারকোটিক পারমিট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চুক্তিপত্রসহ বেশকিছু শর্তে শিথিলতা এনে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহের লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়নের পরিপত্র জারী করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। একই পরিপত্রে, শর্তগুলো যাচাই-বাছাই করে প্রতিবছর নতুন লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপর। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত মোট ১১০০টি নতুন লাইসেন্স ও ২০০০টি পুরানো লাইসেন্স নবায়ন করতে পেরেছে সংস্থাটি। অনেক ক্ষেত্রে পরিপত্রে উল্লেখিত নিয়মের ধার ধারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দেশব্যাপী ব্যাঙের ছাতার মতে আনাচে কানাচে গজিয়ে উঠা অনুমোদন হীন ক্লিনিক, হাসপাতালের সংখ্যা রয়েছে প্রায় ১০ হাজার। দৈনিক দেশবাংলার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহের অনুমোদনে আইন ভঙ্গের ভয়াবহ চিত্র। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোনো একটি হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার আছে, অথচ নেই নারকোটিক পারমিট। আবার কেউ পরিবেশের ছাড়পত্র দিলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চুক্তিপত্র দিতে পারেনি। এমনও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের পরিবেশ ছাড়পত্র, নারকোটিক পারমিট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চুক্তির কোনোটিই নেই; অথচ তারা অনুমোদন পেয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ডা. মো. বেলাল হোসেন (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা নির্বিঘ্ন করা ও মানবিক কারণে কিছু প্রতিষ্ঠানকে এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অনেকেই ইতোমধ্যে পরিবেশ ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন সেসবের রশিদ আমাদেরকে দিয়েছেন। যারা আবেদন করেছেন, অথচ এখনো সনদ পাননি, তাদেরকে বিবেচনা করা হয়েছে’। লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল বন্ধে অভিযান চলবে? এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড় পত্র ও নারকোটিক পারমিট ছাড়া চলতি বছরে যেসব প্রতিষ্ঠান কে লাইসেন্স দিয়েছেন তা কি আইনের লঙ্ঘন নয়? সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কি কোন ব্যাবস্থা নেয়া হবে? এমন প্রশ্নে তিনি নীরব হয়ে যান। কথা শেষ না করেই মোবাইলের সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিপত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকার পরও সনদ ছাড়াই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স ইস্যু করাকে আইনের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন হিউম্যানিস্ট সোসাইটিরর এক মানবাধিকার কর্মী । তিনি বলেন, যখনই দায়িত্বশীল জায়গা থেকে কেউ আইন পরিপন্থী কাজ করবে এবং সেই কাজটাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করবে, ধরে নিতে হবে সেখানে দুর্নীতি হয়েছে। নারকোটিক পারমিট ছাড়া অপারেশন থিয়েটার চালানোর অনুমোদন দেওয়ার অর্থ হলো- ড্রাগের অবৈধ ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া। রাষ্ট্র জেনে বুঝে সেটা করতে পারে না। একই কথা পরিবেশ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য, ধারালো বর্জ্য, সংক্রমণ সৃষ্টিকারী বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র প্রয়োজন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুচারু না হলে যে কোনো সময় পবিবেশের ক্ষতিসহ জনজীবন বিপন্ন হতে পারে। একেতো চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষ আস্থা হারাচ্ছে, দেশের একটা বিরাট অংশ চিকিৎসার জন্য বিদেশ চলে যাচ্ছে, সেখানে স্বয়ং অধিদপ্তরের এমন বেআইনি কর্মকাণ্ড দুঃখজনক। এতে দেশের চিকিৎসার ওপর আরও আস্থাহীন হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষ। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়ে, শুধুমাত্র রশিদ দেখে ছাড়পত্র দেওয়া ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশ সচিব জিয়াউল আহসান। তিনি বলেন, ‘এই হাসপাতাল ছাড়পত্র নাও পেতে পারে। কেবল জমা রশিদকে বিবেচনায় নিয়ে কি করে একটি হাসপাতালের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে, বুঝতে পারছি না’।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায, অনলাইনে আবেদন করার ব্যবস্থা করা হলেও তদবির ছাড়া লাইসেন্স মেলে না। আর তদবির না করলে, কাগজপত্র পাঠিয়েও কাজ হয় না। সরেজমিন অনুসন্ধানেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে। পিওন থেকে শুরু করে কর্মকর্তাদের পিছনে কাগজপত্র নিয়ে ছুটতে দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আসা হাসপাতাল মালিকদের। ইতোমধ্যে অর্থের বিনিময়ে লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়া কয়েকটি চক্রের বিষদ তথ্য রয়েছে দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি’র কাছে । দেখা যাচ্ছে, তাদের সাথে রয়েছে অধিদপ্তরের বড় বড় কর্মকর্তাও। নাম সর্বস্ব অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতালের নানান অনিয়ম নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন দেখতে চোখ রাখুন দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি পত্রিকায়।