গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে সেই রিকশাচালক ছকুকে নির্যাতনের পর হত্যা মামলার আসামিরা সংবাদ প্রকাশের জেরে নিউজবাংলার গাইবান্ধা প্রতিনিধি ও প্রেসক্লাব গাইবান্ধার সহ-সাধারণ সম্পাদক পিয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন। সেই মামলায় ছকু হত্যার বাদী ও সাক্ষীকেও আসামি করা হয়েছে।
বুধবার বিকেলে গাইবান্ধা নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতের বিচারক আবদুর রহমান মামলাটি গ্রহণ করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, চলতি বছরের ১৫ মে গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার পূর্ব দামোদরপুর গ্রামের মন্টু মিয়ার মেয়ে মনিকা আকতার (১৪) অপহরণ হয়। ঘটনার সাথে ছকু হত্যা মামলার বাদি মোজাম্মেল হক, সাংবাদিক পিয়ারুল ইসলাম, তার ছোট ভাই ওয়ারেস সরকার, চাচা আসাদুল ইসলাম, ছকু হত্যার পর আন্দোলনে অংশ নেয়া একরামুল হক ও তার ছোট ভাই ইউসুপ আলী মেয়েটিকে অপহরণ করে। এরপর মোজাম্মেল মেয়েটিকে ঢাকার গাজীপুরে নিয়ে আটকে একাধিকবার ধর্ষণ করে।
অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগ এনে মেয়েটির মা রিপা বেগম বাদী হয়ে গত ২৩ জুন ৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার আবেদন করেন।
গত ২৮ জুলাই মামলার আবেদনটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। তদন্ত শেষে
৪ নভেম্বর চারজনকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয় গাইবান্ধা পিবিআই এর তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই দিপংকর সরকার।
তবে ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। এছাড়া ছকু হত্যা মামলার ৯ আসামিই হয়েছেন ধর্ষণ ও অপহরণ মামলাটির সাক্ষী হিসেবে।
ছকু হত্যা মামলার এজাহারে বলা হয়, পূর্ব দামোদরপুর গ্রামের ছয় ভাই আলমগীর, আংগুর, রনজু, মনজু, সনজু ও মন্টু মিয়া দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় দাদনের কারবারে জড়িত। তাদের সঙ্গে একই গ্রামের রিকশাচালক ছকু মিয়ার পারিবারিক ও দাদনের টাকা নিয়ে বিরোধ ছিল। ছকুর ছেলের সঙ্গে মন্টু মিয়ার মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে সেই বিরোধ আরও বাড়ে।
এ নিয়ে গত ১৫ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ছকু মিয়াকে তারই বাড়িতে আটকে হাত-পা বেঁধে ফেলে ছয় ভাইসহ তাদের লোকজন। রাতভর ছকুর ওপর চালায় অমানবিক নির্যাতন। এ সময় তার এক হাত ও একটি দাঁত ভেঙে যায়। এ ছাড়া তার গোপনাঙ্গে আঘাত করা হয়।
পরদিন সকাল থেকেই ছকু মিয়ার বাড়িতে তাকে জিম্মি করে রাখা হয়। পরে পরিবারের লোকজন তাকে হাসপাতালে নিতে চাইলে ছকুর দুই ভাই মহাব্বর ও জহিরকে মারপিট করা হয়। পরে গ্রামবাসিরাও তাকে হাসপাতালে নিতে পারেনি।
ওই দিন দুপুরে স্থানীয় সংবাদকর্মী পিয়ারুল ইসলাম ঘটনাটি জানার পর ৯৯৯ এ ফোন করলে পুলিশ ছকুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে তিনদিন চিকিৎসা করার পর আসামিদের ভয়ে পালিয়ে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেয় ছকু।
এক সপ্তাহ পর ছকুকে সেখান থেকে ধরে এনে স্থানীয় চেয়ারম্যান এজেডএম সাজেদুল ইসলাম স্বাধীনের উপস্থিতিতে সালিশ বৈঠকে ‘ছেলের প্রেমের খেসারত’ হিসেবে ছকুর ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সেই টাকার জন্য ছকুর একমাত্র ঘরটিও ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন দাদন কারবারিরা। এরপর তাকে ভিটেছাড়া করা হয়। পরে ছকু মিয়া আশ্রয় নেন গাজীপুরের ছেলের বাসার। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩ জুন মৃত্যু হয় তার।
গ্রামবাসি ও নিহত ছকু মিয়ার পরিবার জানায়, ছকুর মরদেহ নিয়ে ছেলে মোজ্জাম্মেল ও মেয়ে ছোমেলা সাদুল্লাপুর আসেন ওই রাতেই। রাতভর মোজাম্মেলসহ তার পরিবার সাদুল্লাপুর থানায় মামলা করতে চাইলে পুলিশ মামলা নেয়নি। আসামিরা চেয়ারম্যান স্বাধীনের মাধ্যমে মিমাংসার প্রস্তাবের আশ্বাস দিয়ে মরদেহ বাড়িতে নিয়ে যায়। পরদিন ৪ জুন মোজ্জাম্মেল ও বোন ছোমেলাকে ঘরবন্দি করে চেয়ারম্যানের উপস্থিতে তারা মরদেহ দাফন করে।
দাফনে মোজাম্মেলসহ পরিবারের কাউকেই অংশ নিতে দেয়া হয়নি। ওই দিনই মোজাম্মেল ও তার বোনকে গ্রামছাড়া করে দাদন কারবারিরা।
কয়েকদিন পর মোজাম্মেল পার্শবর্তী উত্তর মরুয়াদহ গ্রামের কৃষক আবদুর রাজ্জাকের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। পরে ১৬ জুন মোজাম্মেল আদালতে মামলা করেন। এরপর আদালত সাদুল্লাপুর থানাকে মামলা রেকর্ডভুক্ত করে মরদেহ উত্তোলনসহ প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেন।
মামলার পর মোজাম্মেলকে সেখানেও বিভিন্ন হুমকি দিয়ে আসছে আসামিরা। এ ঘটনায় মামলা ছাড়াও নিরাপত্ত চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি ও আদালতে একটি মামলাও (৭ ধারা) করেন তিনি। যা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলাটি জেলাজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়। পরে গ্রামবাসি, ইউনিয়ন ও উপজেলাবাসির ব্যানারে মানববন্ধনসহ বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
মরুয়াদহ গ্রামের আবদুর রাজ্জাক জানান, মূলত হত্যা মামলা ধামাচাপা ও বাদি-সাক্ষীসহ সংবাদকর্মীকে হয়রানি করতেই এ মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। পিবিআই কার্যালয়ে আসামিপক্ষের বক্তব্য শোনার পর তদন্তকারী কর্মকর্তা দিপংকর কৃষক আবদুর রাজ্জাকের কাছে ১৫ হাজার টাকা দাবি করেন। কিন্তু রাজ্জাক টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সেখান থেকে সবাইকে নিয়ে চলে আসেন।
এরপর দিপংকর বাদিপক্ষের সাজানো সাক্ষীদের কথা মতো নাটকীয় ঘটনা বানিয়ে এ প্রতিবেদন দেয়। এরমধ্যে আসামিপক্ষ কিংবা গ্রামবাসির কোন মতামত নেয়া হয়নি।
এ নিয়ে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘ওই পুলিশ (তদন্তকারী কর্মকর্তা) মন্টু (টাকা) চাইছিল পনের হাজার। হামরা কিসক মন্টু দিমো। হামার তো অপরাধ নাই।’ সেই তেকনে (ঘুষ না দেয়া) ওমার ঠাই (বাদিপক্ষ) টেকা খায়া এগলে করছে পুলিশ। এটা কোন বিচার হল- বলেন আবদুর রাজ্জাক।
সেই দিন একই গ্রামের ভ্যানচালক মধু মিয়াও যান পিবিআই অফিসে। তিনি বলেন, ‘একে একে সব শুনছে। আসার আগে হাত দিয়ে টেকার ইশারা করে পুলিশ। হামরা কছি সত্যের পথে ফাঁসি হোক। টেকা দিবের পাব না।’
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে আসামিপক্ষে আইনজীবী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমার মক্কেল মোজাম্মেল একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার বাদি। এছাড়া আরেকজন মামলাটির সাক্ষী। আর সাংবাদিক পিয়ারুল নির্যাতিত ছকুকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করাসহ ঘটনাটি ফলাও করে প্রতিবেদন প্রচার করে। যা জেলাজুড়ে আলোচনায় আসে।’
মূলত আমার মক্কেলদের হয়রানি ও হত্যা মামলা থেকে রেহাই পেতে আসামিরা মামলাটি করেছে। এটা একটা ভিত্তিহীন মামলা বলেন জাহাঙ্গীর হোসেন।