পরিবহন খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রেখে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাজেট চূড়ান্ত করেছিল পরিকল্পনা কমিশন। এডিপির আকার ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল।
এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা ও বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৭০ হাজার ৫০১ কোটি ৭২ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়। তবে সংশোধিত এডিপি বা চূড়ান্ত এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তা খাতে কমছে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। ফলে চূড়ান্ত উন্নয়ন বাজেট দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকা।
মঙ্গলবার (০২ মার্চ) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) সভায় চূড়ান্ত উন্নয়ন বাজেট অনুমোদন দেওয়া হবে। গণভবনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এনইসি সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এনইসি সভা অনুষ্ঠিত হবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, চূড়ান্ত উন্নয়ন বাজেট বা সংশোধিত এডিপিতে সরকারের নিজস্ব তহবিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে কমছে বৈদেশিক সহায়তা খাতে।
পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের যুগ্ম প্রধান (কৃষি, শিল্প ও সমন্বয় উইং) মো. ছায়েদুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, অনেক আগে থেকেই আমরা আরএডিপি নিয়ে কাজ করছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের চাহিদার কথা আমাদের কাছে উল্লেখ করছে। অনেক প্রকল্পে বরাদ্দ বেশি চাওয়া হচ্ছে। আবার করোনার কারণে কিছু প্রকল্পে টাকা খরচ হচ্ছে না। সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক ঋণ সহায়তা খাত থেকে শুধু মাত্র সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কমছে। এছাড়া এডিপি ও সংশোধিত এডিপির মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকছে না। মঙ্গলবার এনইসি সভায় আরএডিপি চূড়ান্ত করা হবে।
এডিপিতে বৈদেশিক ঋণ ছিল ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। আরএডিপিতে এ বরাদ্দ কমিয়ে ধরা হচ্ছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) কাটছাঁটের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে।
সংশোধিত এডিপিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকছে পরিবহন খাতে প্রায় ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ, টাকার হিসাবে ৫২ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ ভৌত অবকাঠামো খাতে ২৫ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা।
তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ বিদ্যুৎ খাতে ২৪ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা ও চতুর্থ সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে শিক্ষা খাতে ২৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ১৮ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা, পল্লী উন্নয়ন খাতে ১৫ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা, স্বাস্থ্যখাতে ১৩ হাজার ৩৩ কোটি টাকা, কৃষিখাতে ৮ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা, পানিসম্পদ খাতে ৫ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা এবং জনপ্রশাসন খাতে ৪ হাজার ৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের কারণে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপিতে কমছে উন্নয়ন প্রকল্প। বরাদ্দসহ অনুমোদিত প্রকল্প যুক্ত হচ্ছে ১ হাজার ৫৮৮টি (স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া)। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৪৪টি। ফলে নতুন অর্থবছরে কমছে ১৫৬টি উন্নয়ন প্রকল্প।
করোনার প্রভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাজ এগোয়নি বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্পের। ফলে বরাদ্দের অর্থ পুরোটা খরচ হচ্ছে না। বিশেষ করে বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের ব্যয় কমছে। সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) বিদেশি সহায়তার অংশে বরাদ্দ কমছে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের এডিপিতে মোট বরাদ্দের ৩২ দশমিক ৮৫ শতাংশের জোগান আসার কথা বিদেশি ঋণ সহায়তা থেকে। গত ছয় মাসে এই উৎস থেকে পাওয়া গেছে প্রায় ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। সাধারণত বছরের প্রথম দিকে এডিপি বাস্তবায়ন এবং দেশি-বিদেশি অর্থছাড়ের গতি কম থাকে। আগের তিন অর্থবছরের প্রথমার্ধে বিদেশি উৎসের ব্যয়ের প্রবণতা বিশ্নেষণে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছিল ১৭ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যয় হয় ১৯ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় ছিল ৮ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, বিদেশি সহায়তার বরাদ্দ কাটছাঁটের মধ্যেও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। করোনার সংক্রমণ এড়ানো এবং চিকিৎসাসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের কথা বিবেচনায় এ খাতে বরাদ্দ তিন হাজার ৫৩৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। মূল এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি সহায়তার বরাদ্দ ছিল চার হাজার ৩২১ কোটি টাকা। আরএডিপিতে এখাতের বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়াতে পারে সাত হাজার ৮৫৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের সময় করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় মূল এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ যথেষ্ট হয়নি বলে সমালোচনা করেন অর্থনীতিবিদরা।
বিদেশি উৎসের বরাদ্দ থেকে কাটছাঁটে আকারে সবচেয়ে বেশি কমছে বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে। মূল এডিপি থেকে বরাদ্দ কমছে পাঁচ হাজার ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এডিপিতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ১২১ কোটি টাকা।
মেগা প্রকল্পের মধ্যে বরাদ্দ কমছে পদ্মাসেতু প্রকল্পে। পরিকল্পনা কমিশনে চাহিদাপত্র অনুযায়ী সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পে মাত্র ২ হাজার ৯৯ কোটি টাকা চেয়েছে সেতু বিভাগ, যেখানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ ছিল ৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের আওতায় ২ হাজার ৯০১ কোটি টাকা খরচই হচ্ছে না।
পদ্মাসেতু ও মেট্রোরেলসহ মেগা প্রকল্পকে গুরুত্ব দিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রাখা হয় ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। উন্নয়ন বাজেটে পদ্মাসেতু প্রকল্পে ৫ হাজার এবং চলমান মেট্রোরেল প্রকল্পে ৫ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়।
করোনা সঙ্কট কেটে সবকিছু স্বভাবিক অবস্থায় আসবে, এই আশা নিয়েই এডিপি অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনা মহামারি দীর্ঘদিন থাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে খরচ হচ্ছে না ২ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। বরাদ্দ কমছে কর্ণফুলি টানেল প্রকল্পেও। তবে এডিপির অর্থ খরচে সফলতা দেখিয়েছে মেট্রোরেল প্রকল্প।
সূত্র জানায়, বর্তমানে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে পরিকল্পনা কমিশন। চলতি বছরের মার্চের শেষের দিকে চূড়ান্ত হবে আরএডিপি। অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের বাস্তবায়িত প্রকল্পে চাহিদার কথা পরিকল্পনা কমিশনে জানিয়েছে। প্রতিবছরের মতো এবারও চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বড় ধরনের কাটছাঁট হবে। মূলত বাস্তবায়ন না হওয়ায় এই কাটছাঁটে যাচ্ছে সরকার।