সাদুল্লাপুর : গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের দামোদরপুরে দাদন ব্যবসায়ী ছয় ভাইয়ের রাতভর নির্যাতনে ছকু মিয়া (৫০) নামে এক রিকশা চালকের মৃত্যুর অভিযোগ তুলে মরদেহ দাফনের ১২ দিন পর আদালতে মামলা করেছে নিহতের ছেলে মোজাম্মেল।
বুধবার ১৬ জুন বিকেলে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সাদুল্লাপুর) আদালতে এই মামলা করেন তিনি। পরে আদালতের বিচারক শবনম মুস্তারী সাদুল্লাপুর থানায় মামলা রেকর্ডভুক্ত করে আগামী সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেন।
নিহত ছকুর ছেলে মোজাম্মেল বলেন, ‘আমার মা তিন বছর আগে মরছে। আব্বাও চলে গেছে। ঘর টাও ওরা ভাঙি নিচে। আমরা এখন ইতিম (এতিম) দুই ভাই-বোন কোনটে যামো। হামরা হত্যার বিচার চাই।
এজাহারে সূত্রে জানা যায়, সাদুল্লাপুর উপজেলার পূর্ব দামোদরপুর গ্রামের ছয় ভাই আলমগীর, আংগুর, রনজু, মনজু, সনজু ও মন্টু মিয়া দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় দাদনের কারবার চালিয়ে আসছেন। দীর্ঘদিন ধরে ছয় ভাইয়ের সাথে রিকশা চালক ছকু মিয়ার পারিবারিক ও দাদনের টাকা নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল। এছাড়া ছকুর ছেলের সাথে মন্টু মিয়ার মেয়ের প্রেম ভালবাসা নিয়ে পূর্ণরায় বিরোধ সৃষ্টি করেন ছয় ভাই।
এ নিয়ে গত ১৫ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ছকু মিয়ার বাড়িতে যায় ছয় ভাইসহ তাদের লোকজন। এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা এলোপাতাড়ি মারডাং শুরু করে রিকশা চালক ছকুকে। তাদের মধ্যে রনজু মিয়া হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ছকুর অন্ডকোষে লাথি দেন। আর মন্টু বুকের উপর দুই পা দিয়ে পরপর কয়েকবার আঘাত করেন। এভাবেই রাতভর ছকুর উপর ছয় ভাই ও তাদের লোকজন চালায় অমানবিক পাষবিক নির্যাতন।
পরদিন ১৬ মে গুরুত্বর ছকুকে পরিবারের লোকজন হাসপাতালে নিতে গেলে প্রভাবশালী ছয় ভাই বাধা দেয়। সেই সাথে হত্যার হুমকি আর ভিটে ছাড়ার ভয় দেখায় ।
এই অমানবিক ঘটনাটি ১৬ মে বিকেলে স্থানীয় সংবাদকর্মীর নজরে আসে। পরে তিনি উপায় খুঁজে না পেয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ ফোন করেন ও পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ছকুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। তারা ছকু মিয়াকে হাসপাতালে গিয়েও হত্যার হুমকি অব্যাহত রাখে।
এলাকাবাসি জানান, ঘটনার পাঁচদিন পর দামোদরপুর ইউপি চেয়ারম্যান সাজেদুল ইসলাম স্বাধীনের উপস্থিততে শালিশ বৈঠকে ছেলের প্রেমের খেসারত হিসেবে ছকু মিয়ার পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
সেই টাকার জন্য ছকুর একমাত্র ঘরটি ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন দাদন কারবারিরা। এরপর তাকে ভিটে ছাড়া করা হয়। পরে বাধ্য হয়ে ছকু মিয়া আশ্রয় নেন গাজীপুরে ছেলের বাসার। সেখানে হাসপাতালের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী তিনি চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ৩ জুন মৃত্যু বরণ করেন।
মামলার বাদি ছকু মিয়ার ছেলে গার্মেন্টসকর্মী মোজাম্মেল হক জানান, জরিমানার বাকি ৩৫ হাজার টাকার জন্য তার বাবাকে ভিটে ছাড়া করা হয়। টাকা না আনা পর্যন্ত তাদের বাড়িতে না আসতে হুমকিও দেয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘আব্বার লাশ ঢাকাত থাকি বাড়িত আনচি। তারপর আমাকে ও বোনকে ঘরত তালা দিয়ে লাশ কবর দেয় ওরা। আব্বাক শেষ দেখাটাও দেখতে দেয় নাই ওমরা। কবরে মাটি পর্যন্ত দিতে দেয়নি ওরা আমাকে।’
‘আমার বাপকে ওরা সারা রাত মারপিট করে। আব্বা পানি চাইছিল; ওরা পানিও খেতে দেয় নাই। এজন্য আব্বা আজ চলে গেছে। আমি এ হত্যাকান্ডের বিচার চাই!’
মোজাম্মেল বলেন, ‘আমার মা তিন বছর আগে মরছে। আব্বাও চলে গেছে। ঘরটাও ওরা ভাঙি নিচে। আমরা এখন ইতিম (এতিম) দুই ভাই-বোন কোনটে যামো।’
এ বিষয়ে বাদি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বিচারক এজাহার আমলে নিয়েছেন। আগামী ২৩ জুনের মধ্যে মামলা রেকর্ডভুক্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘পাষবিক নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে রিকশা চালক ছকু মিয়ার। নির্যাতনের ঘটনায় নিহতের ভিডিও বক্তব্যসহ পত্র-পত্রিকার কার্টিং আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আশা করছি, আমার মক্কেল সঠিক ন্যায় বিচার পাবেন।’
সাদুল্লাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুদ রানা আদালতের কোন নথি পাইনি বলে জানান।