দেশের ‘সোনালি আঁশ’ খ্যাত পাট তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়েছে অনেক আগেই। কালের বিবর্তনে পাটের সেই কদর এখন আর নেই। পাটের সোনালি অতীত এখন কেবলই ইতিহাস। এরপরও পুরোনো ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন পাট চাষিরা।
আশা-নিরাশার দোলাচালে এখনও বছর বছর তাই কৃষকের আঙিনা রঙিন করে রাখছে এই সোনালি আঁশ। প্রতিবছর এক বুক স্বপ্ন নিয়ে পাট চাষ করেন গ্রামের সাধারণ কৃষক। রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে কাজ করেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাটি থেকে ফসল ফলান। সবুজ পাটকে রূপান্তরিত করেন সোনালি বর্ণে। এরপরও বিক্রি করতে গিয়ে পড়েন দুর্বিপাকে। কখনো ভালো দাম পান; আবার কখনও একেবারেই পান না! অনেক সময় আবার লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয় বেশি। এরপরও সামান্য লাভের আশায় প্রতি বছরই পাটের আবাদ করেন।
পাটের দাম নিয়ে সংশয় থাকেই। তবে এবার পাটের দাম ভালো পাওয়ায় কপাল খুলেছে কৃষকদের। নতুন সম্ভাবনায় এবছর কৃষকের মনে সেই ভয় কেটেছে। যেন আবারও সোনালি আঁশের সুদিন ফিরে পেয়েছেন তারা।
বাজারে ওঠার শুরুর দিকেই এবার এক হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকা মণ দরে পাট বিক্রি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে সাড়ে ৫ হাজার টাকা মণ দরে পাট বিক্রি হচ্ছে। যা দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রেকর্ড।
আর এমন দাম এবারই প্রথম, বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই পাটের দাম বেশি দাম পাওয়ায় পুঁজি তো উঠেছেই। মাঠের পাট টাকা হয়ে কাঙ্ক্ষিত মুনাফাও ঘরে গেছে। গেল কয়েক বছরের লোকসানের পর লাভের মুখ দেখে তাই কৃষক ও ব্যবসায়ীরা বেজায় খুশি। অনেকেই পাট চাষে নতুনভাবে আগ্রহী হয়ে উঠছেন এবছর।
রাজশাহীর পবা উপজেলার পিল্লাপাড়া গ্রামের পাটচাষি নুরুল আমিন বলেন, এবার তিনি আট বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছিলেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ভালো ফলন হয়েছিল। তবে ভালো দাম পাবেন না বলে প্রথমদিকে কিছু পরিমাণ পাট বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সেই তুলনায় বাজারে পাটের দাম প্রায় দ্বিগুণ। এমন ভালো দাম সবার কল্পনাতীত বলেও উল্লেখ করেন তৃণমূলের এই পাটচাষি।
উপজেলার নওহাটা হাটের পাট ব্যবসায়ী আলী হোসেন বলেন, গেল বছর মণপ্রতি পাট বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার ৫০০ টাকায়। শেষের দিকে কিছুটা দাম বাড়ে। এক হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হয়। এবার বাড়তে বাড়তে সাড়ে ৫ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। আরও বাড়তে পারে৷ বিশ্ব বাজারে হঠাৎই সুতার দাম বেড়েছে। এজন্য পাটের দামও বেড়েছে বলে উল্লেখ করেন রাজশাহীর পবা উপজেলার এই পাট ব্যবসায়ী।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোছা. উম্মে ছালমা জানান, রাজশাহী জেলার নয় উপজেলায় গেল বছর (২০২০) ১৪ হাজার ১৭০ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু চাষাবাদ হয়েছে ১৪ হাজার ১৯৬ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ আরও ২৬ হেক্টর বেশি জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে।
এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে ১৩ হাজার ৮৪৬ হেক্টর জমিতে পাটের চাষাবাদ হয়েছিল। ফলে পরিসংখ্যান বলছে এই দুই বছর থেকে রাজশাহীতে পাটের আবাদ বেড়েছে। তাই আবাদ বেশি। আর এখন দামও বেশি। তবে পাটের এমন ভালো দাম এবারই প্রথম বলে জানান।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাটের দাম কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় ভালো। এজন্য স্থানীয় কৃষকরা আবারও পাটচাষে ঝুকছেন। ক্রমাগত লোকসানের কারণে যারা পাট বিমুখ হয়ে পড়েছিলেন তারাও পাট চাষের কথা চিন্তা করছেন। এতেই সুদিন ফিরতে শুরু করেছে সোনালি আঁশের। দেশে বেসরকারি পাটকলগুলো খোলা আছে। তাই সরকারি পাটকল বন্ধ থাকলেও পাট বিক্রিতে কৃষকের সমস্যা হচ্ছে না।
এছাড়া দেশ-বিদেশে এখন পলিথিন ও প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য থেকে মানুষ ফিরে আসছে। তাদের মধ্যে পাটের তৈরি ব্যাগগুলোর ব্যাপক চাহিদা। এজন্য বেসরকারি পাটকলগুলোর উৎপাদন চালু রয়েছে। আর বেসরকারি পর্যায়ের তরুণ উদ্যোক্তারাও পাটজাত পণ্য তৈরি ও বিক্রিতে উৎসাহিত হচ্ছেন। এই সফলতা অব্যাহত থাকলে আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে সোনালি আঁশ তার অতীত ঐতিহ্য আবারও ফিরে পাবে।
এদিকে, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো রাজশাহীর সহকারী পরিচালক কাজী সাইদুর রহমান জানান, কয়েক বছর থেকে পাট রফতানি বাড়ছেই। কারণ পাটের দাম বাড়ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজশাহী থেকে দুই কোটি ৩৪ লাখ ৭ হাজার ৫২৮ ডলারের পাট রফতানি হয়েছে।
এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এক কোটি ৮৮ লাখ ১৫ হাজার ৫৮৫ ডলার ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এক কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৯ ডলারের পাট রফতানি হয়েছে। তাই আবারও পাটের সুদিন ফেরার স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা। এমনটাই জানানরফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর এই সহকারী পরিচালক।