সুনামগঞ্জের একমাত্র বাস রাখার জায়গা মল্লিকপুরের নতুন বাস স্টেশন। বাসস্ট্যান্ড ও মাইক্রোস্ট্যান্ড নির্মাণের নামে কোটি টাকার বাণিজ্য হলেও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। একটি যাত্রী ছাউনি, অফিস ঘর ও একটি বড় পুকুর নিয়ে ১৯৯৪ সালে ছয় একর আমন জমির উপর গড়ে উঠেছিল স্টেশনটি। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে যাত্রী ও পরিবহন বেড়েছে, একইসঙ্গে অবকাঠামো হয়েছে ব্যবহার অনুপযোগী। মালিক শ্রমিক ও যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে গেল বছর পুকুর ভরাট করে টার্মিনাল স¤প্রসারণ করার উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও আরেকটি স্থানে মাইক্রোস্ট্যান্ড করার নামে পুকুর ভরাট শুরু করছিলো জেলা পরিষদ। এই দুইটি স্থান ভরাট করতে কেবল বালু বাণিজ্য হয়েছে। পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও যাত্রীদের এখনও কোনো উপকারে আসেনি এই দুই স্ট্যান্ড। ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে শহরের মল্লিকপুর এলাকায় ১৪টি দাগে মোট ছয় একর আমন শ্রেণির জায়গা অধিগ্রহণ করে জেলা প্রশাসনের অধিগ্রহণ শাখা। পরে ধীরে ধীরে সেখানে কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। কয়েকটি ওয়াশরুম, যাত্রী চাউনি ও ইটসলিংয়ের সড়ক করা হয়েছিলো। দীর্ঘদিন এসব অবকাঠামো সংস্কার না করায় বর্তমানে সবই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে আছে। অন্যদিকে যাত্রী ও পরিবহনের সংখ্যা এখন আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বাস্টস্টেশনে পরিবহনের জায়গা সংকুলান হয় না। সুনামগঞ্জ সিলেট সড়কের স্থানে স্থানে সারিবদ্ধ করে বাস রাখায় শহরে প্রবেশমুখে যানজট লেগেই থাকে। অভিযোগ রয়েছে, বাসস্ট্যান্ড ও মাইক্রোস্ট্যান্ড করার নামে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বালু বাণিজ্য করেছেন। পুকুর ভরাটকে কেন্দ্র করে বালু ব্যবসায় হয়েছে তাদের। নদীতে ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে আশেপাশের মানুষের কাছে বালু বিক্রি করেছে তারা। এতে বাসস্টেশন আধুনিকায়ন ও স¤প্রসারণের নামে কোটি টাকারবালু লুটপাট হয়েছে, সুনামগঞ্জবাসির কোনো উপকার হয়নি। বাস মালিক শ্রমিক সংগঠনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিন ৪০০ বাস চলাচল করলেও স্টেশনে ৬০টির বেশি সংকুলান হয় না স্টেশনে। অন্য বাসগুলো সুনামগঞ্জ সিলেট সড়কের তিন কিলোমিটার জুড়ে রাখা হয়। এ কারণে সুনামগঞ্জ শহরে ঢোকার একমুখী সড়কে পরিবহনের ধীরগতি লেগেই থাকে। পরিবহন শ্রমিক আব্দুল মতিন বলেন, বাস স্টেশনে গাড়ি রাখা যায় না, বাইরে সড়কেরপাশে গাড়ি রাখতে হয়। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। আগে পুকুরের পানিতে গাড়ি ধোয়া যেতো, এখন সেটিও বন্ধ। আমাদের বিশ্রামের জায়গা, ওয়াশ রুম নেই। বাস স্টেশনের কাজটি করে দিলে উপকার হয়। সুনামগঞ্জ জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির ম্যানেজার মো. হাফিজুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিনের দাবির মুখে গেল সরকারের আমলে এই পুকুরটি ভরাট করে দেওয়া হয়। তবে যতটুকু দেওয়ার কথা, ততটুকু দেওয়া হয়নি। এমতাবস্থায় গাড়ি এখানে রাখলে দেবে যায়। পরে টাকা খরচ করে মেশিন দিয়ে তুলতে হয়। আমরা বাসস্টেশনের উন্নয়ন চাই, তবে লোক দেখানো কোনো উন্নয়ন চাই না। আমরা আশা করি বর্তমান সরকার এই বাস স্টেশন সংস্কার ও আধুনিকায়নে নজর দেবে। কয়েক মাস আগে পুকুর ভরাট করা হয়েছে। এরপরে আর কোনো অগ্রগতি নেই। যাত্রী শ্রমিকদের জন্য পুরোনো কিছু ওয়াশরুম রয়েছে। কিন্তু এগুলো এখন আর ব্যবহার করা যায় না। শ্রমিকদের জন্য বিশ্রামাগার নেই। ভেতরে একমাত্র ইটসলিংয়ের সড়কের বেহাল অবস্থা। পুকুর ভরাটের জন্য কত টাকা বরাদ্দ হয়েছে, কত টাকার কাজ করা হয়েছে আমরা জানি না। এদিকে মাইক্রোস্ট্যান্ড করার জন্য মল্লিকপুর কালী মন্দিরের পাশে ১৪৫ জেএল নম্বরে ২৫৯ ও ২৬০ দাগে ৬৯ শতাংশ পুকুর শ্রেণির জেলা পরিষদের জায়গা ভরাট করছিলো কতৃর্পক্ষ। মাইক্রোস্ট্যান্ডের নামে এই পুকুর ভরাটকরণের কাজ দেওয়া হয়েছিলো বিগত সরকার দলীয় নেতাদের। এখানেও তারা ড্রেজার মেশিনের মাধ্যমে পুকুর ভরাটের পাশাপাশি স্থানীয়দের কাছে বালু বিক্রি করছে। তবে ৫ আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পরে অবৈধ এই কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তরও বেআইনি। কোনো ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করলে পাঁচ বছরের কারাদ- বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ- অথবা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষক আইন (২০১০ সালের সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ। এই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পুকুরের অর্ধেক ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। পুকুরের একপাশের জায়গা দখল করে তৈরি হয়েছে জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীন কয়েকটি দোকানকোঠা। এসব দোকান থেকে জেলা পরিষদ প্রতিমাসে ভাড়া আদায় করে। মল্লিকপুর এলাকার বাসিন্দা মো. কাশেম মিয়া বলেন, এটি আবাসিক এলাকা। এখানে পুকুর ভরাট করছিলো জেলা পরিষদ। পাঁচ আগস্টের পর কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। নদী থেকে লাগানো পাইপ খুলে নিয়ে গেছে। এখানে এটি হলে আমাদের সমস্যা হবে। স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক ও জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, পুরাতন বাস স্টেশনটি শহর থেকে সরানো জন্য নতুন বাস স্টেশনে মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। এটিকে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য ইতোমধ্যে এককোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে, অনুমোদন পেলে আমরা কাজ শুরু করবো। কাজটি শেষ হলে এটি ব্যবহারের উপযোগী হয়ে যাবে। আশা করি খুব দ্রুত আধুনিক বাস স্টেশন করা সম্ভব হবে। মাইক্রোস্ট্যান্ড করার জন্য পুকুর ভরাটের ব্যাপারে তিনি বলেন, পুকুর শ্রেণির জমি ভরাট আইনের লঙ্ঘন, আমরা নথিপত্র দেখে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।