সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে বিশাল হাওরের বুকে ছোট ছোট গ্রামগুলোকে দূর থেকে দেখলে দ্বীপের মত মনে হয়। এক খন্ড উঁচু ভূমি, এর মধ্যে বসতবাড়ি আর চারপাশে বর্ষায় পানি থৈ থৈ করে। আর শুষ্ক মৌসুমে বোরো জমিতে থাকে সবুজের সমারোহ। কিন্তু নেই চলাচলের জন্য সড়কপথ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পাশের গ্রামের সাথেও। শুধু তাই নয়, জেলা বা উপজেলার সাথেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। হাওরবেষ্টিত তাহিরপুর উপজেলার টাক্সগুয়ার হাওরপাড়ের অর্ধশতাধিক গ্রামগুলোর এমনি অবস্থা বিরাজ করছে। যুগ যুগ ধরে এসব গ্রামের বাসিন্দারা রয়েছেন উন্নয়নবঞ্চিত। জেলার সচেতনমহল বলছেন, পরিবারে অসচ্ছলতা ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এই হাওরপাড়ের শিশুরাও শিক্ষার দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। কাজের সন্ধানে অনেকেই ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে গেলেও যারা অবস্থান করছে তারা উন্নয়নবঞ্চিত হয়ে বংশপর¤পরায় হাওরপাড়েই পড়ে আছেন বাবা-দাদার ভিটায়। এভাবেই হাজারো পরিবার বসবাস করছে বংশ পর¤পরায়। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ওইসব গ্রামের বাসিন্দারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থান মৌলিক তিনটি অধিকার থেকে যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত হচ্ছেন। শুধু টাক্সগুয়ার হাওরই নয় মাটিয়ান, শনি হাওরসহ বিভিন্ন হাওরবেষ্টিত গ্রামগুলোতে একই চিত্র দেখা গেছে। এসব গ্রামের বাসিন্দাগণ শুষ্ক মৌসুমে মাটির সড়ক দিয়ে পায়ে হেটে কোনো রকমে চলাচল করতে পারলেও বর্ষায় নৌকা ছাড়া বের হওয়ার কোনো উপায়ও নেই। তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের টাক্সগুয়ার হাওরের পাশেই গোলাবাড়ি গ্রামে প্রতিটি বাড়ির বাসিন্দারা কোনো রকমে চারদিকে টিনের বেড়া আর নিচে মাটির দিয়ে ঘর তৈরি করেন। অনেকেই ইটের দেয়াল তৈরি করে বসবাস করছেন। এই গ্রামের এমাল মিয়া (৩২) পেশায় জেলে। তার চার ছেলে আর বৌসহ পরিবারের সদস্য ৬ জন। শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধান চাষাবাদ করেন অন্যের জমিতে, নিজের জমি নেই। আর দিনমুজুরি করেই জীবন-জীবিকা পরিচালনা করে। তার এই আয়েই সংসার চলে। তিনি জানান, এই হাওর এলাকায় সরকারি বা বেসরকারিভাবে কলকারখানা বা কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকতো তাহলে হাওর এলাকার বিশাল এই জনগোষ্ঠী বেকার থাকত না। কর্মসংস্থান না থাকায় বছরের ৯ মাসই বেকার থাকতে হয় আমাদের। কর্মহীন হয়ে আমরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছি। তিনি জানান, হাওরে গত কয়েক বছর ধরে বর্ষায় মাছও পাওয়া যায় না। হাওরে মাছ পেলে বাজারে বিক্রি করে চাল ডাল কিনে নেই। মাছ না পেলে কষ্টের শেষ নাই। আমাদের হাওরপাড়ের মানুষের পাশে কেউ নাই। একই অবস্থা বিরাজ করছে গোলাবাড়ি গ্রামের মতিঝিল মিয়ার (৩৫)। যৌথ পরিবারে এক বোন, তিন ভাই, মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তানসহ ৬সদস্যের পরিবার। একেই গ্রামের কামাল মিয়া (৩০) ৪ ছেলে নিয়ে বসবাস করছেন। তারা জানান, টাক্সগুয়ার হাওরেপাড়ের জয়পুর, গোলাবাড়ি, মুঝরাই, মন্দিআতা, চিলানী তাহিরপুর, লামাগাও, পৈন্ডুবসহ হাওরপাড়ের গ্রামের বাসিন্দাদের একই অবস্থা। পরাগ মিয়া, কবির মিয়া, লতিফ মিয়াসহ আরও অনেকে জানান, হাওর নিয়ে কাজ করা কিছু সংস্থা হাওরপাড়ের বাসিন্দাদের নিয়ে কোনো কাজই করছে না। মাঝে মধ্যে কিছু সভা-সেমিনারে কথা বললেও সারা বছরেই নিষ্ক্রিয় থাকে। আমরা যুগ যুগ ধরে বঞ্চিতই রয়ে গেলাম। দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আহমদ মোরাদ জানান, অবহেলিত হাওরপাড়ের বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান নেই ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় যুগ যুগ ধরে হাওরপাড়ের মানুষ অবহেলিত রয়েছে। তাদের জন্য আলাদাভাবে সরকারি বরাদ্দ ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সমাজকর্মী আবুল হোসেন বলেন, হাওরাঞ্চলের গ্রামের বাসিন্দাদের জন্য শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য দায়িত্বশীলগণ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করলে হাওরবাসীর জীবন-জীবিকার উন্নয়ন হবে। না হলে তারা পিছিয়ে থাকবেন।