ঝড়-জলোচ্ছাসের আঘাত থেকে রক্ষা করাসহ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবিকার বন্দোবস্ত করা সুন্দরবন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে প্রকৃতির এক অপার দান। যখন থেকে এসব এলাকায় লোকবসতি শুরু হয়েছে; তখন থেকেই সুন্দরবনের ওপর ভর করে চলছে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো।
তবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার জোগান দিতে করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে বিপুল পরিমাণ বনসম্পদ আহরণ। ফলস্বরূপ ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবন হারাতে বসেছে জীববৈচিত্র্য।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বন উজাড় হয়েছে শুধু ২০০০ থেকে ২০১৫ সময়কালে। বাংলাদেশে বন উজাড়ের এ হার আরও ভয়াবহ। এসময়ে উজাড় হয়েছে দেশের মোট বনভূমির প্রায় ২ দশমিক ৬ শতাংশ। সে হিসেবে দেশে বছরে উজাড় হয় ২ হাজার ৬০০ হেক্টর বনভূমি।
পরিবেশ ও বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ অধিদফতরের তথ্যমতে, বর্তমানে সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার, যা ১৯১১ সালে ছিল প্রায় ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশের প্রায় ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার ম্যানগ্রোভ বনভূমি দেশের মোট আয়তনের ৪.২ শতাংশ এবং মোট বনাঞ্চলের ৪৪ শতাংশজুড়ে বিস্তৃত।
জাতীয় তথ্য বাতায়ন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রয়োজনীয় মাছের প্রায় ৫ শতাংশ জোগান দেয় সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদী। প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার টন মাছ আহরিত হয় সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা থেকে। এছাড়া প্রায় ৩৬ হাজার টন চিংড়ি ও কাঁকড়া এবং কয়েক কোটি চিংড়ির পোনা আহরিত হয় সুন্দরবন সংলগ্ন নদী থেকে।
এসব মাছ ও কাঁকড়ার কিছু প্রজাতির আবার একটি নির্দিষ্ট জীবনকাল রয়েছে। তাই সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাকে বাধাধরা নিয়মের ভেতরে কয়েক দশক রাখলেই যে প্রকৃত ক্ষত কাটিয়ে ওঠা যাবে, এমনটা নয়। দরকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পণা ও এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন।
যেমন সুন্দরবন অঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য যুগোপযোগী বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো যেতে পারে। সেই সাথে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে নিম্ন আয়ের এসব মানুষকে সংযুক্ত করে পরিমিত পরিমাণে বনজসম্পদ আহরণ দেশের অর্থনীতির চাকাকেও সচল রাখবে। নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পাবে জাতীয় সম্পদ।
কারণ বনজসম্পদ আহরণে লোকজ জ্ঞান অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেমন মৌয়ালরা এমনভাবে মৌচাক কাটেন যাতে যথাসম্ভব কম মৌমাছি মধু সংগ্রহের কাজে সৃষ্ট ধোয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গোলপাতা সংগ্রহকারী বাওয়ালরা এমনভাবে পাতা কাটেন যাতে গাছের কেন্দ্রীয় পাতা এবং তার পাশের পাতার কোনো ক্ষতি না হয়।
বনজীবীদের ছাড়া বহিরাগতদের এসব প্রথাগত কৌশল জানা থাকে না বলে স্থানীয় বনজীবীদের সংযুক্ত না করে সর্বোচ্চ সুফল অর্জন সম্ভব নয়। এ ছাড়া পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় নিম্ন আয়ের এসব মানুষের কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম কেন্দ্র হতে পারে।
ইতোমধ্যে সরকার বন ও বনজীবী রক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করলেও প্রকৃত সেবাপ্রত্যাশীরা বঞ্চিত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে এলাকাবাসীর। যেমন অন্য পেশায় পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত যাতে মৎস্যজীবীরা পরিবার পরিচালনায় হিমশিম না খায়, এর জন্য সরকার চালু করেছে ‘জেলে সহায়তা কার্ড’।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রকৃত মৎস্যজীবীদের অনেকেই আছেন সরকারের এ তালিকার বাইরে। এসব সহায়তা অবৈধভাবে গ্রহণ করছেন বিত্তবান অমৎস্যজীবীরাও। ফলে বরাদ্দকৃত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে একরকম বাধ্য হয়েই মৎস্যজীবীদের অনেকেই মাছ ধরায় সরকারি নিষেধাজ্ঞার সময়ে সুন্দরবনের সম্পদ অবৈধ উপায়েই আহরণ করছেন।
অনেকে আবার বনরক্ষীদের কাছে ধরা পড়ার ভয়ে এবং স্বল্প সময়ে মাছ আহরণ করতে বিষ দিয়ে মাছ ধরার মতো কাজে লিপ্ত হচ্ছেন। গাছ কেটে অনেকে শুধু গুড়িগুলো সংগ্রহ করে ফেলে আসছেন কাণ্ড, শাখাগুলো। যেগুলো আগে জ্বালানি কাঠের জোগান দিতো নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে।
এ জন্য ন্যূনতম সময়ে বন রক্ষার মিশনে সাফল্য আনতে বনের সাথে গড়ে ওঠা এতদিনের এ জনগোষ্ঠীর বন নির্ভরতা এক আদেশেই কমানো সম্ভব নয়। এতে বাড়বে বনকে ঘিরে চোরাচালান ও অপরাধীর দৌরাত্ম। বন ও বনজীবীদের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষায় দরকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন।