দেশের তরুণ সমাজের বড় একটি অংশের অনুপ্রেরণা ও আদর্শ ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। তার উত্থান-পতনে ঘেরা প্রায় দুই দশকের ক্যারিয়ার যে কারও জন্যই অধ্যবসায় ও নিজের লক্ষ্যের প্রতি অটুট থাকার এক বড় মন্ত্র।
নিজের জীবনের সেই গল্পের খানিকটা শুনিয়েছেন মাশরাফি। সোমবার ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) ভার্চুয়াল সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সফলতম অধিনায়ক। যেখানে কথা বলেছেন অনেক বিষয় নিয়ে।
শুধু নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ার নয়, নিজের জীবনের গল্প-অভিজ্ঞতা, জাতীয় জীবনের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রভাব এবং সবশেষে আক্ষেপ নিয়েও কথা বলেছেন মাশরাফি। তার বিশ্বাস, একের পর এক ইনজুরিতে না পড়লে ক্যারিয়ারে তিনশ টেস্ট উইকেট পেতেন, যেখানে তার এখন রয়েছে মাত্র ৭৮টি। কেননা ইনজুরির কারণে বেশিদিন টেস্ট খেলতেই পারেননি।
ইউল্যাবের সমাবর্তনে দেওয়া মাশরাফির পুরো বক্তব্যটি নিচে তুলে ধরা হলো:
আপনারা আজ স্নাতক হলেন। নতুন জীবনে পা দিচ্ছেন, শুভকামনা জানাই। আমার বক্তব্য খুব বেশি কিছু বলার নেই। আমার মনে হয় না যে খুব বেশি কিছু বলতে পারবো। তারপরও যেগুলো আমার জীবনে দেখেছি, মুখোমুখি হয়েছি, আমি যেভাবে দেখি, সেগুলো তুলে ধরতে চাচ্ছি। ভুল হলে ক্ষমা করবেন। আপনারা যে জীবনে আজকে পা দিচ্ছেন, অনেক পরিশ্রম করেছেন, বাবা-মায়ের শ্রম ছিল। যে ধাপটা পার করে সামনে পা দিচ্ছেন, এই জীবনটা কঠিনই। অনেকে ভাবতে পারে একটা জায়গায় যাচ্ছি, খুব সহজ। তা নয়।
আমার মনে হয় রিল্যাক্স থাকা জরুরি। মানুষ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মানুষ মেহনত করতে পারে, চেষ্টা করতে পারে।আমি নিশ্চিত এই পর্যন্ত আপনারা যেভাবে এসেছেন, চেষ্টা করেই। সেটা অব্যাহত থাকবে বলেই আশা করি।
আমাদের সামনে জ্বলন্ত উদাহরণ আছে। বঙ্গবন্ধুর জীবন যদি দেখি। আমাদের দেশের জন্য পুরো জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, উনি জেল খেটেছেন, পরিবার থেকে দূরে থেকেছেন, পরে আমরা স্বাধীনতা পেলাম। এরপর ‘৭৫ সালে কী নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হলো। আল্লাহর রহমতে প্রধানমন্ত্রী ও শেখ রেহানা আপা বেঁচে গেছেন।
এরপর যদি দেখেন, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলেন। এরপর স্বৈরাচার পতনের নেতৃত্ব দিলেন। দল ক্ষমতায় আসলো। আমি বলতে চাচ্ছি, মানুষের চেষ্টা থাকলে সে সফল হবেই। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
আমি আমার জীবনের দুটি বিষয় হয়তো বলতে পারি। আমি খুব ছোট জেলা থেকে এসেছি। আমি যখন ক্রিকেট খেলা শুরু করি। আমি অনূর্ধ্ব-১৭, ১৯, এ দল হয়ে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছি। আমরা নড়াইলে যখন ছিলাম, ঐ সুবিধাদি ছিল না। আমরা যে ক্রিকেট খেলব, কোচিং যে বিস্তর আকার ধারণ করেছে… কোচ ছিল না, ফিটনেস ট্রেনার ছিল না। আমার কাছে মনে হয়েছে আমি খুব উপভোগ করেছি। আমি খুব অল্প বয়সে বুঝতে পেরেছিলাম, ক্রিকেটটা পছন্দ করি, খেলতে চাই।
জীবনের কঠিন সময় যখন এলো, আমার ইনজুরি। আমার যখন অপারেশন হলো, ২০০১ সালে ভারতে গেলাম। তখন ৪টা টেস্ট খেলেছি, তিনটি ওয়ানডে খেলেছি। হসমত হসপাতাল নাম, ডাক্তার থমাস চেন্ডি। আমি পায়ে ব্যথা পেলাম, উনি বললেন দেখে দিচ্ছি। পরে এমআরআই করালো। পরের দিন সকালে বলল যে তোমার লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। তোমার অপারেশন করাতে হবে এবং এক বছর খেলার বাইরে থাকতে হবে।
আমি একা গিয়েছিলাম। ঢাকায়ই কম এসেছি, সেখানে ভারতে গিয়েছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল আকাশটা আমার মাথায় ভেঙে পড়েছে। এরপর ওখান থেকে ফিরে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ভালোভাবে খেলেছি। এরপর পরের তিন বছরে আবার চারটা ইনজুরি। সেখান থেকে ফিরে এসে ১৪৪ থেকে ১২০ কিলোমিটারে বল করা। ওটাকে ম্যানেজ করা, সাতটা অপারেশন করা। আমি যখন মাঠে নামতাম, বুঝতাম কী করি।
আমি বাংলাদেশের জন্য খেলছি, এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু ছিল না। তখন আমি আসলে। আমি জানি ওই দিন কেমন গেছে। স্পোর্টসে সর্জিারির চেয়েও রিহ্যাবিশন প্রক্রিয়াটা কঠিন। আমি বিশ্বাস করি আমার চাওয়া, ডেডিকেশন, স্পোর্টস নিয়ে ফোকাস ছিলাম। সেটার কারণে ২০১৫ সালে এসে অধিনায়কত্ব পেয়েছি।
আমি এটাই বুঝাতে চেয়েছি ২০ বছরের ক্যারিয়ারে আরও অনেক বেশি কিছু করতে পারতমা। আমি সুস্থ থাকলে তিনশ উইকেট পেতাম টেস্টে, ওয়ানডেতে আরও বেশি পেতাম। কিন্তু এটা নিয়ে আমার কোনো কষ্ট নাই। কারণ আমি জানি চেষ্টা করেছি। এজন্য খারাপ লাগে না। আল্লাহ সবাইকে সুযোগ দেয়, এগুলো নেওয়া খুব জরুরি।