ছদ্মবেশে ১৭ বছর ধরে পলাতক থাকা স্ত্রীকে হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
গ্রেফতার আসামির নাম মো. আশরাফ হোসেন ওরফে কামাল (৪৭)। বৃহস্পতিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) রাতে ঢাকার সাভার এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
র্যাব জানায়, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি হওয়ার কারণে পালিয়ে থাকতে সাংবাদিকতার মতো মহান পেশা বেছে নেয় আশরাফ হোসেন ওরফে কামাল। নামসর্বস্ব সাংবাদিকদের একাধিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং বিভিন্ন পত্রিকার পরিচয়পত্র নিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন।
আসামি কামালের মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে বরিশালে অভিযান চালানো হয়। তবে ওই নম্বরটি আসামি ব্যবহার না করায় তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। পরবর্তীতে র্যাব সাইবার পেট্রোলিংয়ের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পেজে আসামির ফুটপ্রিন্ট শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হয়।
শুক্রবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, গত বছরের ২১ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও থানা থেকে একটি পত্রে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সাজাপ্রাপ্ত পরোয়ানাভুক্ত আসামি আশরাফ হোসেন ওরফে কামালকে গ্রেফতারের জন্য র্যাবের কাছে অনুরোধ করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। মামলায় উল্লেখিত মোবাইল নম্বরের ভিত্তিতে বরিশালে অভিযান চালানো হয়। মোবাইল নম্বরটি আসামির নামেই রেজিস্ট্রেশন ছিল। কিন্তু ব্যবহার করছেন অন্যজন।
‘মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে জানা যায়, আসামি কামাল দীর্ঘদিন নম্বরটি ব্যবহার না করায় কর্তৃপক্ষ সিমটি অন্য ব্যক্তির কাছে রিপ্লেসমেন্ট সিম হিসেবে বিক্রি করেছে। ফলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে শনাক্ত করে গ্রেফতার করা সম্ভব হয় না। পরবর্তীতে র্যাব সাইবার পেট্রলিংয়ের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসামির ফুটপ্রিন্ট শনাক্ত করে। এরপর মাঠপর্যায়ে তথ্যের সঠিকতা যাচাই করে। ফেসবুকে আসামির আশরাফ হোসেন নামে দুটি পেজের সন্ধান পাওয়া যায়। তার পেজে র্যাবের ব্রিফিংয়ের কয়েকটি বক্তব্য শেয়ার করা ছিল। তার পেজের ছবির সঙ্গে তার ছবির মিল পাওয়া যায়।’
এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব-১১-এর অভিযানে বৃহস্পতিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) রাতে ঢাকার সাভার এলাকা থেকে স্ত্রীকে হত্যা করে ছদ্মবেশে ১৭ বছর ধরে পালিয়ে থাকা আশরাফ হোসেন ওরফে কামালকে গ্রেফতার করা হয়।
কামালকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং মামলার চার্জশিট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে পারিবারিক কলহের জেরে আশরাফ তার শিশুপুত্রের সামনে শ্বাসরোধ করে স্ত্রী সানজিদা আক্তারকে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গোপন করতে মৃতের ওড়না দিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে মরদেহ ঝুলিয়ে দেয় এবং প্রচার করে, তার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছে। পরে এ ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা হয়। মরদেহের সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। ইতোমধ্যে ঘটনাটি সন্দেহজনক হওয়ায় আসামিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা মোতাবেক গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়। ১২ দিন পর শ্বশুরের সহায়তায় জামিন পান কামাল। জামিন পাওয়ার পরপরই আত্মগোপনে চলে যান। এরপর তিনি কখনই স্থায়ী ঠিকানা নোয়াখালী ও তার কর্মস্থল, নিজ সন্তান ও আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি।
এদিকে, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্বাসরোধে সানজিদা আক্তারকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর সোনারগাঁও থানা পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করে, যার নম্বর ৪২। মামলার এজাহারনামীয় একমাত্র আসামি মো. আশরাফ হোসেন ওরফে কামাল।
মামলার তদন্তে জানা যায়, সিলিং ফ্যানের নিচে খাট ছিল। ওই খাটের উপর থেকে সিলিং ফ্যানের উচ্চতা খুবই কম ছিল। সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করা সম্ভব না। প্রতীয়মান হয় যে, আসামি কামাল তার স্ত্রী সানজিদা আক্তারকে হত্যা করেছে। তদন্ত শেষে দণ্ডবিধি ৩০২/২০১ ধারার অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে সোনারগাঁও থানা আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত বিচার শেষে মামলার পলাতক আসামির বিরুদ্ধে পেনাল কোড ১৮৬০-এর ৩০২/২০১ ধারায় অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে আইনের ওই ধারার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আশরাফ হোসেন ওরফে কামাল ১৯৯৮ সালে হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে বি.কম (পাস) ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি সোনারগাঁওয়ে একটি সিমেন্ট কোম্পানিতে ২০০১ সাল থেকে চাকরি শুরু করে। পরবর্তীতে তিনি ২০০৩ সালে ভুক্তভোগী সানজিদা আক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয়। এরপর তিনি সস্ত্রীক কোম্পানির স্টাফ কোয়ার্টারে বসবাস শুরু করেন। ঘটনার পর তিনি ছদ্মবেশে আশুলিয়ায় বসবাস শুরু করেন। প্রথম স্ত্রীর ঘটনা গোপন করে পুনরায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন। পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশাকে গ্রেফতার এড়ানোর ছদ্মবেশ হিসেবে বেছে নেয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার আশরাফ হোসেন জানান, আশুলিয়া এলাকায় তিনি ২০০৬ সালে সাপ্তাহিক মহানগর বার্তার সহকারী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। ২০০৯ সালে তিনি আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের সদস্যপদ লাভ করেন। পরবর্তীতে সংবাদ প্রতিক্ষণ পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ২০১৩-১৪ মেয়াদে আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন। ২০১৫-১৬ মেয়াদে আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের সহ-সম্পাদক পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন। ২০১৬-১৭ মেয়াদে তিনি আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের নির্বাহী সদস্য পদ পান। ২০২০ সালে দৈনিক সময়ের বাংলা পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০২১-২২ মেয়াদে পুনরায় আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের পুনরায় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন। বর্তমানে তিনি আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের সদস্য ও স্বদেশ বিচিত্রা পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, দীর্ঘ এই সময়ে তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন গার্মেন্টস ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। নিজে একটি কনসালটেন্সি ফার্মও খোলেন। ফার্মটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশ যাচাইয়ের নিরীক্ষার কনসালটেন্সি করতো। গ্রেফতার আসামির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান র্যাবের এ কর্মকর্তা।