স্বাধীনতার ৫০ বছরে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে উপনীত হয়েছে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দলটিকে স্বাধীন দেশেও অধিকাংশ সময় ক্ষমতার বাইরে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে থাকতে হয়েছে।
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বসহ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় দলটি অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য স্থাপনে সক্ষম হয়েছে। স্বাধীন দেশেও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে দলটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস স্থাপন করেছে।
পশ্চাৎপদ ও ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পাকিস্তানের অধীনস্ত পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরনো ঢাকার কে এন দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলটির প্রতিষ্ঠা হয়। তখন মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের অসাম্প্রদায়িক একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে নতুন এ দল গঠন করেন। প্রতিষ্ঠার প্রায় চার বছর পর ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে। জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে। এই আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দলটির নেতৃত্বেই ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বিজয় অর্জন করে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সংকটে পড়তে হয় আওয়ামী লীগকে। দীর্ঘ সময় দেশে একের পর এক আসা সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে ঐহিহ্যবাহী দলটি।
স্বাধীনতার পর এই সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আওয়ামী লীগকে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। জাতীয়ভাবে অনেক সংকট মোকাবিলা এবং দলের অভ্যন্তরীণ ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে। কখনো নেতৃত্বের শূন্যতা, কখনো দমন-পীড়ন, কখনো ভাঙনের মুখে পড়তে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর নেতৃত্ব শূন্যতায় পড়ে আওয়ামী লীগ। নেতৃত্বের এই শূন্যতা থেকেই দলের মধ্যে একাধিক ভাঙন-গ্রুপিং ও বহু ধারায় বিভক্তি দেখা দেয়। দলের নেতাকর্মীদের ওপরও নেমে আসে জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা-খুন। এক ধরনের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে দলটি। দলের চরম ক্রান্তিকালে ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন।
’৭৫ পরবর্তী সময়ে একের পর এক সামরিক শাসনের কবলে পড়ে দেশ। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে ঘুরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে দ্বিধা-বিভক্ত আওয়ামী লীগ আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। প্রায় ৪ দশক ধরে তার নেতৃত্বে দলটি পরিচালিত হচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শুরু হয় সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের গতিধারা ও সফলতা যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বের প্রধানতম শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখে আওয়ামী লীগ।
দীর্ঘ পথ পরিক্রমার এই সময়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি চার বার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। তবে স্বাধীনতার এই ৫০ বছরে বেশিরভাগ সময়ই ক্ষমতার বাইরে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে থাকতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। সামরিক ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, মৌলবাদ ও সম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন, সর্বোপরি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে দলটি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছর এবং ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৫ বছর এবং বর্তমানে তিন মেয়াদে টানা ১৩ বছরের বেশি সময় আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে।
আজকের এই পর্যায়ে আসতে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে অগ্রসর হতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার আগে দীর্ঘ ২১ বছর দলটিকে রাজপথে থাকতে হয়। ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর আবারও ২০০১ সালে ক্ষমতার বাইরে গিয়ে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়। দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে দলটির ওপর বার বার আঘাতও এসেছে। বার বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সমাবেশে তাকে লক্ষ্য করে গুলি, বোমা, গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তাকে হত্যার জন্য আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।
’৭৫ পরবর্তী সময়ে সংকট কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় ও দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয় আওয়ামী লীগকে। এর পর দ্বিতীয় দফায় ২০০৭ সালে আওয়ামী লীগকে আবারও বড় ধরনের সংকটে পড়তে হয়। যদিও এই সময়টি পুরো রাজনৈতিক পরিবেশের ওপরই আঘাত নেমে আসে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হন। দীর্ঘ প্রায় ১ বছর তাকে কারাগারে থাকতে হয়। দলের প্রথম সারির অনেক নেতাও তখন গ্রেফতার হন। অনেকে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। এই পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে নেতাকর্মীরা সংগঠিত হয়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন। শেষ পর্যন্ত তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এরপর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় নিযে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় আসার পরও এই সময়ে আওয়ামী লীগকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে।