রাজধানীর রামপুরায় সড়কে নিহত শিক্ষার্থী মাঈনুদ্দিন রাস্তা পারাপারের সময় মারা যায়নি বরং সে নিহত হয় অনাবিল পরিবহনের হেলপারের ধাক্কায় বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে।
বুধবার (২৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর কাওরান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, গত ২৯ নভেম্বর রাতে রাজধানীর রামপুরায় বাসচাপায় শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাসে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটিয়েছিল একটি কুচক্রী মহল। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) অভিযান চালিয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনায় জড়িত এমন চারজন গ্রেফতার করেছে।
মঙ্গলবার (২৮ ডিসেম্বর) রাতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব সদরদপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৩ এর অভিযানে রাজধানীর রামপুরা ও কুমিল্লা অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতাররা হলেন- অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ঘটনার অন্যতম হোতা মনির হোসেন (৫৪), মো. হৃদয় হাসান পারভেজ (১৯), মো. আলাউদ্দিন সিফাত (২৫) ও মো. নাঈম হাসান মীর (২৪)।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গত ২৯ নভেম্বর রাজধানী রামপুরায় বাসচাপায় শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি বাসে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক ও ভয়ভীতি সৃষ্টি করে অরাজকতা তৈরির অপচেষ্টা করা হয়। এসময় চলমান শিক্ষার্থীদের ‘হাফ ভাড়া’ ইস্যুকে উসকে দিতে অপপ্রচার চালানো হয়। ঘটনার পর জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) সহিংসতার পেছনের কারণ উদ্ঘাটনে নিবিড়ভাবে গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু করে। মাঠ পর্যায়ে তদন্ত, বিভিন্ন ফুটেজ বিশ্লেষণ ও তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্তদের শনাক্ত করতে সক্ষম হন গোয়েন্দারা। পরে র্যাব ও এনএসআই যৌথ অভিযান পরিচালনায় তাদের গ্রেফতার করা হয়।
‘জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা র্যাবকে জানায়, মনিরের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় রামপুরায় বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। রামপুরার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো দেশব্যাপী একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির পরিকল্পনা ছিল তাদের। তারা জানতে পারে গাজীপুরে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে রামপুরায় সম্ভাব্য উত্তেজনা সৃষ্টির আশংকা রয়েছে। ওই ঘটনাকে ব্যবহার করে তারা রামপুরার বিটিভি ভবন এলাকায় সম্ভাব্য নাশকতা ও অগ্নিসংযোগের প্রস্তুতি নেয়।’
গাজীপুর চৌরাস্তার ঘটনা সম্পর্কে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ২৯ নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বাসচাপায় নিহত মাঈনউদ্দিনের ভগ্নিপতি সাদ্দাম ও তার বন্ধুর সঙ্গে অনাবিল বাসে ওঠা নিয়ে বাগবিতণ্ডার ঘটনা ঘটে। এর সূত্র ধরে সাদ্দাম ও তার বন্ধু অন্য একটি বাসে গাজীপুর থেকে রামপুরায় রওয়ানা দেয়। পথিমধ্যে তরা রামপুরা এলাকায় তাদের নিকটাত্মীয় ও বন্ধুদের বাসটিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য জড়ো হতে বলে। এরই ধারাবাহিকতায় বাসচাপায় নিহত মাঈনউদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন রামপুরায় জড়ো হয়। সুযোগের অপব্যবহার করার লক্ষ্যে গ্রেফতাররাসহ সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা নাশকতা ও অগ্নিসংযোগের পরিকল্পনা করে
গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব জানায়, গ্রেফতার মনির নাশকতা সংগঠনের জন্য আলাউদ্দিন ও নাঈমসহ আর চার-পাঁচজনকে নির্দেশনা দেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আলাউদ্দিন ও হৃদয়সহ আরও তিন-চারজনকে বোতলে ভর্তি অকটেন সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। গ্রেফতার নাঈম অগ্নিসংযোগকারী দল, সন্ত্রাসী ও হামলাকারী দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে। ঘটনার সংগঠনে চক্রের বিশ্বস্ত ১৫ থেকে ২০ জনকে অগ্নিসংযোগ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। গ্রেফতাররা সুপরিকল্পিতভাবে গাজীপুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রামপুরায় ঘটতে যাওয়া সম্ভাব্য ঘটনাকে ব্যবহার করে নাশকতার পরিকল্পনা করে। মূলত এই চক্রটি চলমান শিক্ষার্থীদের জন্য ‘হাফ ভাড়া’ ইস্যু অপব্যবহারের উদ্দেশ্যে নাশকতার জন্য প্রস্তুত ছিল।
‘গ্রেফতাররা পরিকল্পনা অনুযায়ী রামপুরায় বিটিভি ভবনের সামনে অবস্থান নেয়। তারা সাদ্দামের গাজীপুর থেকে রামপুরায় পৌঁছানোর বিষয়টি জানতে পারে। এর মধ্যে তারা বাসের নাম জেনে নেয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে নাশকতাকারীর সহযোগীরা অবস্থান নিয়ে বাসটি আসার আগাম তথ্য দেয়। বাসটি রামপুরার বিটিভি ভবনের সামনের এলাকা অতিক্রমকালে তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ফলে অনাবিল বাসচালক ও হেলপার সম্ভাব্য হামলা আঁচ করতে পেরে বেপরোয়া গতিতে রামপুরা ত্যাগ করতে যায়। বাসটি ৪০০-৫০০ মিটার অতিক্রম করার পর সাদ্দাম ও তার শ্যালক বাসটি পলাশবাগে থামাতে চেষ্টা করে। একপর্যায়ের সাদ্দামের শ্যালক নিহত মাঈনউদ্দিন বাসে জোরপূর্বক উঠতে গেলে বাসের হেলপার তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এমন সময় বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মাঈনউদ্দিন মৃত্যুবরণ করে।’
র্যাবের দাবি, তখন সুযোগ সন্ধানীরা শিক্ষার্থী নিহত বলে প্রচারণা করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে উত্তেজনা ছড়ায়। একইসঙ্গে তারা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাস্তায় চলমান বাস ও অন্যান্য যানবাহনে অকটেন ঢেলে অগ্নিসংযোগ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেফতাররা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে ও তাদের অন্য সহযোগীদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। গ্রেফতার সংঘবদ্ধ নাশকতা দলের অন্যতম হোতা মনিরের বিরুদ্ধে বিস্ফোরকদ্রব্যসহ নাশকতার সাতটি মামলা রয়েছে। সে একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের একজন এজেন্ট। সে রামপুরার বাসে অগ্নিসংযোগ ঘটনার অন্যতম সংগঠক ও পরিকল্পনাকারী। তার নির্দেশনায় গ্রেফতাররা রামপুরায় নাশকতা সৃষ্টিতে নানাবিধ দায়িত্ব পালন ও সশরীরে অংশগ্রহণ করে নাশকতা পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ, সমন্বয় ও অগ্নিসংযোগ ঘটায়।
গ্রেফতারদের সম্পর্কে র্যাবের মুখপাত্র বলেন, গ্রেফতার আলাউদ্দিন তার নিজ গ্যারেজসহ আরও কয়েকটি স্থানে বোতলভর্তি অকটেন মজুত রাখে ও সরবরাহ করে। গ্রেফতার হৃদয় সশরীরে বাসে অগ্নিসংযোগ করে ও গ্রেফতার নাঈম বিভিন্ন গ্রুপগুলোর ভেতরে সমন্বয় করে। রাষ্ট্রবিরোধী এই ষড়যন্ত্রকারীদের যোগসাজশে রামপুরার সিন্ডিকেটটি সুযোগসন্ধানী অপতৎপরতা চালিয়ে ধ্বংসাত্মক ও জানমালের ক্ষতিসাধন, নাশকতা, বিশৃঙ্খলা ও অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনার অন্যতম হোতা মনির হোসেন একটি রাজনৈতিক দলের ওয়ার্ড সভাপতি। মূলত তারই নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কোনো আর্থিক লেনদেন ছিল না। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে ফায়দা নেওয়া।
প্রসঙ্গত, গত ২৯ নভেম্বর রাত ১১টার দিকে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় অনাবিল সুপার পরিবহনের বাসচাপায় মাঈনুদ্দিন নামে এক শিক্ষার্থী নিহত হয়। এ ঘটনায় রাতে সড়ক অবরোধ করে উত্তেজিত জনতা। এসময় আটটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। ভাঙচুর করা হয় আরও চারটি বাস। মাঈনুদ্দিন নিহতের ঘটনায় তার মা রাশিদা বেগম সড়ক দুর্ঘটনা আইনে মামলা করেন। একই ঘটনায় রামপুরা এলাকায় আটটি বাসে আগুন ও চারটিতে ভাঙচুর করায় পৃথক একটি মামলা করে পুলিশ। মামলায় অজ্ঞাত পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।