1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : জাতীয় অর্থনীতি : জাতীয় অর্থনীতি
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৯ অপরাহ্ন

১৩ জুন সৈয়দপুরের ট্রেন ট্রাজেডি দিবস

শাহজাহান আলী মনন
  • আপডেট : শনিবার, ১২ জুন, ২০২১

সৈয়দপুর (নীলফামারী)  প্রতিনিধিঃ

১৩ জুন সেই ভয়াল দিন। গোলাহাট ট্রেন ট্রাজেডি দিবস। নীলফামারীর সৈয়দপুরের ইতিহাসের এক নির্মম গণহত্যার হৃদয়বিদারক স্মৃতিবহ দিন। একাত্তরে পাকিস্তানি  বর্বর বাহিনি ও তাদের দোসর কিছু বিহারী সেদিন ট্রেন থামিয়ে ৪৪৮ জন নিরীহ হিন্দু মাড়ওয়ারিকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিলো।

সৈয়দপুরে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলো বিহারি কাইয়ুম খান। এই কাইয়ুম খানের নির্দেশেই পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় স্থানীয় ৮ শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাসহ দুই হাজারেরও বেশি মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী বাঙালিকে হত্যা করে কুখ্যাত রাজাকার ইজহার আহমেদ ও তার সহযোগীরা। ঘাতক বিহারি ইজহারের এ হত্যাযজ্ঞের নাম ছিল ‘খরচা খাতা’। তার প্রধান সহযোগী কাইয়ুম খান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে চলে যায়।

সৈয়দপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রণীত বাঁশবাড়ী (পুরনো ৫নং ওয়ার্ড) রাজাকারদের তালিকায় ইজহারের নাম ১ নম্বরে। সৈয়দপুরের একাধিক মুক্তিযোদ্ধা, প্রত্যক্ষদর্শী ও ১৯৭৩ সালে করা একটি যুদ্ধাপরাধ মামলা সূত্রে জানা যায়, একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের নির্দেশনা অনুসারে তৎকালীন বাংলার অন্যান্য স্থানের মতো সৈয়দপুরেও সর্বাত্মক প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেন অবাঙালি অধ্যুষিত সৈয়দপুর শহরের বিহারি রাজাকার ইজহার। তার নেতৃত্বে বিহারিরা ২৩ মার্চ সৈয়দপুর শহরের নিরীহ বাঙালিদের ওপর হামলা চালায় এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তায় সৈয়দপুর শহরবাসীকে অবরুদ্ধ করে।

খবর পেয়ে ২৪ মার্চ অবরুদ্ধ সৈয়দপুরবাসীকে উদ্ধারে ছুটে আসেন দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার সাতনালা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাহতাব বেগের নেতৃত্বে কয়েক হাজার মুক্তিকামী মানুষ। এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের বুলেটের আঘাতে নির্মমভাবে নিহত হন মাহতাব বেগ। তখন মাহতাব বেগের মৃতদেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে হাতে নিয়ে উল্লাসও করেছিলো ইজহার। নির্মম এ ঘটনার সাক্ষী আজও রয়েছে সৈয়দপুরে।

শহীদ মাহতাব বেগের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা মির্জা সালাউদ্দিন বেগ সেদিনের সেই বিয়োগান্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি  বলেন, ‘তার বাবা ১৯৬৫ সালে আনসার ট্রেনিং নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে তার বাবা স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের পক্ষে অবস্থান নেন। এটা সহ্য করতে পারেনি রাজাকার ইজহার। ২৪ মার্চ মুক্তিকামী বাঙালিদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করতে রাজাকার ইজহার তার বাবাকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তার মস্তক ছিন্ন করে হাতে নিয়ে বাঁশবাড়ী এলাকা ঘুরে উল্লাসও করেছিল। এঘটনা মনে হলে আজও শিউরে উঠি।’

একাধিক মুক্তিযোদ্ধা জানান, মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দপুরে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল একাত্তরের ১৩ জুন। কাইয়ুম খানের সহায়তায় ইজহারসহ ৪৫-৪৮ জনের রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা ওইদিন ভারতে পাঠানোর কথা বলে সৈয়দপুর স্টেশনে টেনে তুলে দেয় প্রায় পাঁচ শতাধিক মাড়োয়ারিকে। এরপর  পরিকল্পনা অনুসারে স্টেশন থেকে আধা কিলোমিটার দূরে গোনাহাট এলাকায় পৌছে কবরস্থানের কাছে ট্রেন থামিয়ে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে কাইয়ুম ও ইজহারের নেতৃত্বাধীন বাহিনী এবং লুটপাট করে সমস্ত মালপত্র।

এ সময় ট্রেন থেকে পালিয়ে আসা প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজন হারানো তপন দাস কাল্টু ও বিনোদ কুমার আগারওয়ালা বলেন, সেই ঘটনা মনে হলে আজও শিউরে উঠি। চোখের সামনে মুহূর্তে শত শত নারী পুরুষ শিশুকে হত্যা করে ঘাতকরা। সে নারকীয় ঘটনা আজও আমাকে ঘুমাতে দেয়না।

সৈয়দপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মো. জিকরুল হক বলেন, ‘কাইয়ুম ও ইজহারের নেতৃত্বাধীন রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা একাত্তরের ১৩ জুন নির্মমভাবে মুক্তিকামী প্রায় ৪১৩ মাড়োয়ারি নারী, শিশু ও বাঙালিকে হত্যা করেছিল। তলোয়ার, বল্লম ও ছুরি দিয়ে গলা কেটে বেশির ভাগ হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।’ কাইয়ুম খান পাকিস্তানে পালিয়ে রক্ষা পেলেও ঘৃণ্য রাজাকার ইজহার ছিলো।

সৈয়দপুরে জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন ডা. আমিনুল হক ওরফে গোলো ডাক্তার। তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত ছিল রাজাকার ইজহার। পাকিস্তানি সেনারা গোলো ডাক্তারকে সামরিক আদালতে ধরে নিয়ে যায়। তিনি সেখান থেকে ছাড়া পেলেও রাজাকার ইজহারের কবল থেকে ছাড়া পাননি। ২৮ জুন গোলো ডাক্তারকে সৈয়দপুর শহরে মাড়োয়ারিদের একটি পাটের গুদামে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন ইজহার। তিনি তখন এই হত্যাকাণ্ডের নাম দেন ‘খরচা খাতা’।

শহীদ ডাঃ আমিনুল হকের ছেলে প্রত্যক্ষদর্শী সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মহসিনুল হক মহসিন বলেন,  একাত্তরে ইজহার মানুষের গলা কাটত অবলীলায়। মানুষের দেহ-বিচ্ছিন্ন মস্তক নিয়ে পাশবিক উল্লাসে মেতে উঠত সে। শিশুরাও তার রোষানল থেকে সেদিন রেহাই পায়নি।

একাত্তরের ইজহারের ‘খরচা খাতা’ ছিল বহুল আলোচিত। এই খরচা খাতায় যার নাম উঠত তার আর রক্ষা ছিল না। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান কাইয়ুম ও ইজহারের তালিকার ভিত্তিতেই

একাত্তরের ২৩ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিনে হত্যা করা প্রায় দেড়শ’ মুক্তিকামী বাঙালিকে। এর মধ্যে ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ডা. জিকরুল হক, আওয়ামী লীগ নেতা ডা. শামসুল হক, ডা. বদিউজ্জামান, ন্যাপ নেতা ডা. এসএম ইয়াকুব, রেলওয়ে কর্মকর্তা আয়েজউদ্দিন, বিশিষ্ট সমাজসেবী তুলসীরাম আগারওয়াল, রামেশ্বরলাল আগারওয়াল, যমুনাপ্রসাদ কেডিয়া, আইয়ুব প্রমুখ।

এদের কাইয়ুম-ইজহার ও তাদের সহযোগীদের সহায়তায় রংপুর উপশহর এলাকায় নিয়ে গেলে পাকিস্তানি বাহিনী ব্রাশফায়ারে হত্যা করে।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার একরামুল হক সরকার বলেন, “ইজহার সৈয়দপুরের মুক্তিপাগল বাঙালি হত্যাযজ্ঞের নাম দেয় ‘খরচা খাতা’। তার পরিকল্পনাতেই গোলাহাটে ট্রেন থামিয়ে গনহত্যা চালানো হয়।

তাদের স্মরণে সীমিত আকারে গোলাহাট বধ্যভূমিতে নানা কর্মসূচি পালন করা হবে। এনিয়ে শহীদ পরিবারের সন্তান প্রকৌশলী এ কে এম রাশেদুজ্জামানের সভাপতিত্বে প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সুমিত কুমার আগরওয়ালা নিক্কিকে আহবায়ক করে শোকদিবস পালন কমিটি গঠন করা হয়েছে।

গত ১১ ই জুন শুক্রবার সন্ধ্যা ৭ টার সময় স্হানীয় কলিম মোড়ে গোলাহাট ট্রেন ট্রাজেডি পালন উপলক্ষে প্রজন্ম-৭১ এর আহ্বানে এম এম মন্জুর হোসেনের সভাপতিত্বে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
উক্ত আলোচনা সভায় উপস্হিত ছিলেন  আওয়ামী লীগ সৈয়দপুর উপজেলা শাখার সাধারন সম্পাদক ও প্রজন্ম ৭১ এর সাধারন সম্পাদক মহসীনুল হক মহসীন, আওয়ামীলীগ নেতা রাশেদুজ্জামান রাশেদ,  বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা সালাউদ্দীন বেগ,  প্রজন্ম-৭১ এর সাবেক সভাপতি মুজিবুল হক, শহীদের সন্তান ও প্রথম আলোর সাংবাদিক এম আর আলম ঝন্টু,  শহীদ ডাঃ শামসুল হকের সন্তান লিয়াকত হোসেন লিটন, শহীদ সন্তান মোঃ মোনায়মুল হক, হিন্দু কল্যান সমিতির সাধারন সম্পাদক সুমিত কুমার আগার ওয়ালা,  প্রজন্ম-৭১ এর প্রচার সম্পাদক আব্দুর রশীদ, সৈয়দপুর সিটি বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক তামিম রহমান  সহ অনান্যরা।
উক্ত আলোচনা সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৩ ই জুন শহীদদের স্বরনে কর্মসূচী গ্রহন করা হয়
কর্মসুচী গুলো হচ্ছে  কালোব্যাচ ধারন, বিকেল ৪ টায় গরীব দুস্হদের মাঝে খাদ্য বিতরন। বিকেল ৫ টায় গোলাহাট রেললাইন বধ্যভুমিতে শহীদদের স্বরনে পুষ্পমাল্য অর্পন, সংক্ষিপ্ত আলেচনা সভা,  মোমবাতি প্রজ্বলন।
এসব কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংরক্ষিত আসনের সাংসদ রাবেয়া আলীম। বিশেষ অতিথি থাকবেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি মোখছেদুল মোমিন ও পৌর মেয়ের রাফিয়া আক্তার জাহান বেবী। (ছবি আছে)

Please Share This Post in Your Social Media

এই বিভাগের আরো সংবাদ
© ২০২০ দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি