প্রধান নির্বাচন কমিশনার এরই মধ্যে নির্বাচনী সংলাপ শুরু করেছেন; তা অব্যাহত থাকবে। গত ১৩ মার্চ শিক্ষাবিদদের সঙ্গে প্রথম সংলাপ করেছে ইসি। আগামী ২২ মার্চ দেশের ৪০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে সংলাপ করার কথা রয়েছে। ২৯ মার্চ গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সংলাপ করবে এই প্রতিষ্ঠানটি। এর পরেই ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলবে নির্বাচন কমিশন। বিরোধী দলের কোনো নির্বাচনী দাবি থাকলে তা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।
সংসদ নির্বাচনের বাস্তব পরিবেশ কি আছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন বিশ্লেষক ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দলীয় সরকারের আমলে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দলীয় সরকারের আমলে অতীতেও নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছিল না। দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। আমাদের নৈতিকতা-সহনশীলতার দিক থেকে কোনো অগ্রগতি নেই বরং দিন দিন অবনতি হচ্ছে। এ অবস্থায় কীভাবে আশা করা যায়? সবচেয়ে বড় কথা- সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। অবশ্যই সংলাপের মাধ্যমে সমাধান আসতে পারে। সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তিনি বলেন, আমাদের দেশে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে চারটি ছাড়া সব দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে। নির্দলীয় সরকারের আমলে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে সেগুলো গ্রহণযোগ্য হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসন নির্বাচনকে প্রভাবিত করে; এটা তো এখন ঐতিহ্য হয়েছে; সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ অবশ্যই নেই। এই নির্বাচন বিশ্লেষক বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনী পরিবেশ। আমাদের আইন এবং সংবিধানকে অস্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা ছিল তা বাতিল করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে; স্থায়ীভাবে যারা বিরোধী দলে থাকে তাদের জন্য নির্বাচনে বিরূপ পরিস্থিতি বিরাজ করে।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। সংলাপ তারা আগেই শুরু করেছে। নতুন ইসির আগে হোমওয়ার্ক করা দরকার ছিল। ইসিকে কত বিষয়ে স্পষ্ট হতে হবে। সেই বিষয়গুলোর ভিত্তিতে তারা রোডম্যাপ তৈরি করবেন। ইসি কতগুলো কাজ কতে পারে, যেমন- ৯০ অনুচ্ছেদে দলের নিবন্ধনের যে শর্তগুলো রয়েছে তা বাস্তবায়ন করা। তিনি বলেন, দল নিবন্ধনের শর্ত অনুযায়ী সহযোগী সংগঠন থাকবে না, বিদেশি শাখা থাকবে না। ইসির উচিত এগুলো বাস্তবায়ন করা। এ ছাড়া ইসির বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ রয়েছে। যারা সিন্ডিকেট তৈরি করেছে, দলবাজি করে তাদের বাদ দিয়ে দেওয়া। তিনি বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন কেন গ্রহণযোগ্য হলো না তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা এবং সেই অনুযায়ী কাজ করা উচিত বর্তমান নির্বাচন কমিশনের। অন্যদিকে বিএনপি বলছে তারা ভোটে যাচ্ছে না। বিএনপি এখন পর্যন্ত ভোটের বিপক্ষে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের দিকে তাকিয়ে বিএনপি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারা পর্যবেক্ষণে রয়েছে।
ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। বর্তমানে ইসির হাতে যে পরিমাণ ইভিএম সংরক্ষিত আছে, তা দিয়ে প্রায় ১০০ আসনে ভোট গ্রহণ করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে, সেই প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ইসির হাতে এখন পর্যাপ্ত সময় রয়েছে। বিগত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৬টি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সূচনা হয়।
ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত একাদশ সংসদ নির্বাচনে দেশে ভোট কেন্দ্র ছিল ৪০ হাজার ১৮৩টি। ভোটকক্ষ ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২টি। ইভিএমে ভোট গ্রহণের জন্য প্রত্যেক ভোটকক্ষের জন্য একটি ইভিএম প্রয়োজন হয় এবং যান্ত্রিক ত্রুটি বিবেচনায় রেখে প্রত্যেক ভোট কেন্দ্রের জন্য মোট কক্ষের অর্ধেক সংখ্যক ইভিএম অতিরিক্ত সংরক্ষণ করা হয়। সেই হিসাবে ৩ লাখ ১০ হাজার ৯৬৮টি ইভিএম প্রয়োজন হবে ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২টি ভোটকক্ষের জন্য। তবে প্রত্যেক বছরে ২.৫ শতাংশ হারে দেশে ভোটার বাড়ছে এবং পাঁচ বছরের প্রায় ১২.৫০ শতাংশ ভোটার বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে ভোট কেন্দ্র ও ভোটকক্ষের সংখ্যাও বাড়বে আগামী সংসদ নির্বাচনে। ইসির প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে পুরোপুরি ইভিএমে ভোট গ্রহণের জন্য ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ ইভিএমের প্রয়োজন হবে। কিন্তু বর্তমানে ইসির হাতে সংরক্ষিত আছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫৩৫টি ইভিএম।
ইসিকে সাহসী ও নিরপেক্ষ হতে বললেন রাষ্ট্রপতি : নির্বাচন কমিশনকে সাহসিকতার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। গতকাল সন্ধ্যায় নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনাররা বঙ্গভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে এ আহ্বান আসে। নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান এ সময় উপস্থিত ছিলেন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি হাবিবুল আউয়াল ও অন্য চার কমিশনার শপথ নেন। আইনের মাধ্যমে এবারই প্রথম নির্বাচন কমিশনার গঠন করেছেন রাষ্ট্রপতি। নিয়োগ পাওয়ার দুই সপ্তাহ পার করে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা।
রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন গণমাধ্যমকে বলেন, নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং কমিশনারদের অভিনন্দন জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাই মুখ্য।
দায়িত্ব পালনের সঙ্গে ক্ষমতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রপতি আশা করেন নতুন নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে জাতীয় নির্বাচনসহ সব নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে। নির্বাচন কমিশন সবার সহযোগিতায় দায়িত্ব পালনে সফল হবে বলে আশা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপ্রধান।
তিনি বলেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, নির্বাহী বিভাগসহ সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সাক্ষাতের সময় নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং কমিশনাররা দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতির সার্বিক সহযোগিতা ও দিকনির্দেশনা কামনা করেন।
রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব সম্পদ বড়ুয়া, সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহ উদ্দিন ইসলাম, প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন, সচিব (সংযুক্ত) মো. ওয়াহিদুল ইসলাম খান এবং নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খন্দকার এ সময় উপস্থিত ছিলেন।