ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সৌদি আরব ও ভারতের রাষ্ট্রদূতদের দেওয়া বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে সরকার। বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা হলেও প্রতিটি দেশের কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দিতে সবসময় মোতায়েন থাকে বিশাল সংখ্যক নিরাপত্তারক্ষী। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রদূতরা যে স্বাভাবিক নিরাপত্তা পেতেন তা আগের মতোই থাকবে। শুধু বাড়তি নিরাপত্তা (এসকর্ট) দেওয়া হবে না। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে ৫০টি দেশের দূতাবাসে ৭২৭ জন পুলিশ সদস্য সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় মোতায়েন থাকেন। এছাড়া বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) থেকে পাঁচ দূতাবাসে নিযুক্ত রয়েছেন ৮৭ পুলিশ সদস্য।
বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা যে ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ পেয়ে থাকেন, বিদেশে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতরা সে সুবিধা পান না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, পৃথিবীর কোনো দেশেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া হয় না। চলাচলের ক্ষেত্রে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো সুবিধাও পান না তারা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি দূতাবাস, কূটনীতিকদের বাসভবন, ভিসা সেন্টার, স্কুল এবং ক্লাবে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা অব্যাহত থাকবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তায় পুলিশের পক্ষ থেকে নিয়োজিত থাকবেন গানম্যান। এই সশস্ত্র সদস্যরা (গানম্যান) বিশেষ পরিস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন।
কূটনীতিকদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ৯টি সংস্থাকে নিরাপত্তা দিয়ে আসছে ডিএমপি। এসব সংস্থায় নিয়োজিত রয়েছেন ডিএমপির ৪১ সদস্য।
ঢাকায় অবস্থিত বিদেশি হাইকমিশন, দূতাবাস এবং কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে ডিএমপির ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি ডিভিশন। ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি ডিভিশন সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে নিয়োজিত ১৫৬ পুলিশ সদস্য। এছাড়া ব্রিটিশ হাইকমিশনে ২৭ জন, ভারতীয় হাইকমিশনে ৫৮ জন ও সৌদি আরব দূতাবাসে ৫৬ জন পুলিশ সদস্য নিয়োজিত আছেন।
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এবং দূতাবাস সংশ্লিষ্ট স্থাপনায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ৩৯ জন নিয়োজিত আছেন যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে। এছাড়া মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে ১৫ জন, যুক্তরাষ্ট্র ক্লাবে ১২ জন, যুক্তরাষ্ট্র গ্যারেজ এনেক্স ভবনে ২১ জন, যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি চিফ অব মিশনের বাসভবনে ছয়জন ও যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বাসভবনগুলোতে ৩৯ জন পুলিশ সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন।
ঢাকায় থাকা ফ্রান্স দূতাবাসে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন ডিএমপির ২২ সদস্য। এছাড়া জার্মান দূতাবাসে ১৫ জন, দক্ষিণ কোরিয়া দূতাবাসে ছয়জন, থাইল্যান্ড দূতাবাসে ১২ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাত দূতাবাসে ১৮ জন, রাশিয়া দূতাবাসে ৩৩ জন, চীন দূতাবাসে ২৪ জন, অস্ট্রেলিয়া দূতাবাসে ১৫ জন, ফিলিপাইন দূতাবাসে ৩ জন, আলজেরিয়া দূতাবাসে ৬ জন, আফগানিস্থান দূতাবাসে ৩ জন, পাকিস্তান হাইকমিশনে ১২ জন, মরক্কো দূতাবাসে ৩ জন, ব্রুনাই দূতাবাসে ৬ জন, মালদ্বীপ দূতাবাসে ৬ জন, মিয়ানমার দূতাবাসে ১২ জন, মালয়েশিয়া দূতাবাসে ৯ জন, লিবিয়া দূতাবাসে ৬ জন, ফিলিস্তিন দূতাবাসে ৬ জন, তুরস্ক দূতাবাসে ৬ জন, নেপাল দূতাবাসে ৩ জন, ভ্যাটিকান সিটি দূতাবাসে ৩ জন, সুইজারল্যান্ড দূতাবাসে ৩ জন, ইন্দোনেশিয়া দূতাবাসে ১২ জন, শ্রীলঙ্কা হাইকমিশনে ৬ জন, নরওয়ে দূতাবাসে ৯ জন ও ভুটান দূতাবাসে ৯ জন ডিএমপির সদস্য নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছেন।
এছাড়াও কানাডা হাইকমিশনে দায়িত্ব পালন করছেন ১২ জন, ডেনমার্ক দূতাবাসে ১২ জন, ইতালি দূতাবাসে ১১ জন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে ১২ জন, কুয়েত দূতাবাসে ৯ জন, স্পেন দূতাবাসে ৬ জন, মিশর দূতাবাসে ৯ জন, কাতার দূতাবাসে ৩ জন, উত্তর কোরিয়া দূতাবাসে ৬ জন, কসোভো দূতাবাসে ৬ জন, ওমান দূতাবাসে ৩ জন, সিঙ্গাপুর দূতাবাসে ৩ জন, ইরান দূতাবাসে ১৬ জন, ইরাক দূতাবাসে ৬ জন, জাপান দূতাবাসে ২১ জন, নেদারল্যান্ডস দূতাবাসে ১৫ জন, ভিয়েতনাম দূতাবাসে ৬ জন, ব্রাজিল দূতাবাসে ৩ জন ও সুইডেন দূতাবাসে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন ৩ জন পুলিশ সদস্য।
পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ডিএমপির সদস্য ছাড়াও বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) থেকে পাঁচ দূতাবাসে নিরাপত্তা দেন ৮৭ কর্মকর্তা। এরমধ্যে রাষ্ট্রদূতদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় এসবির ক্লোজ প্রটেকশন বিভাগ থেকে নিয়োজিত গ্যানম্যান রয়েছেন ৭ জন। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় ২ জন, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনারের ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় ২ জন, ভারতীয় হাইকমিশনারের নিরাপত্তায় একজন, শ্রীলঙ্কার হাইকমিশনারের নিরাপত্তায় একজন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তায় একজন গ্যানম্যান নিয়োজিত আছেন।
পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে এসবির ডিপ্লোমেটিক অ্যান্ড প্রোটোকল বিভাগ থেকে দুইজন কর্মকর্তা দূতাবাসের নিজস্ব সিকিউরিটি অফিসারদের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। মূলত সারভিলেন্স এবং ডিটেকশনের কাজ করেন তারা। এছাড়াও কূটনৈতিক জোনে এসবির এসএস ডিপ্লোমেটিক অ্যান্ড প্রোটোকল বিভাগ থেকে সাদা পোশাকে ৪০ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। কূটনৈতিক জোনে সিটি-এসবির ৩৮ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন।
ঢাকায় ৯টি আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিসে নিরাপত্তায় রয়েছেন ডিএমপির ৪১ সদস্য। এরমধ্যে- আইওএম অফিসে ৬ জন, আইএফসি ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে ৬ জন, নরডিক ক্লাবে ৬ জন, ইন্টারন্যাশনাল ক্লাবে ৩ জন, ইউএনএইচসিআর অফিসে ৩ জন, টেকনো প্রমেট অফিসে ৩ জন, বিমসটেক অফিসে ৩ জন, ইউনিসেফ অফিসে ৩ জন এবং আমেরিকান ও জাপান স্কুল এস্কর্টে ৮ জন সদস্য নিরাপত্তায় নিয়োজিত।
স্বাভাবিক নিরাপত্তার পাশাপাশি ‘বাড়তি নিরাপত্তা’ দিতেও প্রস্তুত বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিশেষায়িত ‘আনসার গার্ড ব্যাটালিয়ন’ বা এজিবি। তবে দূতাবাসের নিজস্ব খরচে এই ‘বাড়তি নিরাপত্তা’ নিতে হবে। বিদেশি কূটনীতিকদের আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী কীভাবে ‘বাড়তি নিরাপত্তা’ দেবে, তা চূড়ান্ত হয়েছে। শিগগির এ বিষয়ে জানাবে সরকার।
আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এজিবি সদস্যদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতাবাসে টানা ছয় বছর দায়িত্ব পালন করারও অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। এজিবির সদস্যরা দেশে-বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা ভারী অস্ত্র পরিচালনা করতেও সক্ষম। এই ব্যাটালিয়নের (এজিবি) সদস্যরা দেশে-বিদেশে কুইক রেসপন্স ট্রেনিং (কিউআরটি), স্পেশাল ট্যাকটিক্যাল ট্রেনিং (এসটিটি) ও স্পেশাল প্রটেকশন ট্রেনিং, বিশেষ অস্ত্র এবং ট্যাকটিক্যাল ট্রেনিং নিয়েছেন।
আনসারের কর্মকর্তারা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) ও র্যাবে প্রেষণে নিয়োজিত রয়েছেন। এছাড়া ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্যরা সচিবালয়, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা অধিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও র্যাবসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তরে প্রেষণে কর্মরত থেকে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন।
বিদেশি কূটনীতিকদের আনসার বাহিনী কীভাবে অতিরিক্ত নিরাপত্তা (এসকর্ট) দেবে, সেটি চূড়ান্ত হয়েছে। আগামী রোববারের মধ্যে নোট ভার্বালের (কূটনৈতিক পত্র) মাধ্যমে দূতাবাসগুলোকে বিষয়টি জানানো হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। বুধবার (১৭ মে) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন পররাষ্ট্র সচিব।
একই বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হক। তিনি বলেন, কূটনীতিকদের অতিরিক্ত নিরাপত্তা দিতে আনসার বাহিনী প্রস্তুত, আর্থিক বিষয় আলোচনা করে ঠিক করা হবে।
এদিকে, বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বিদেশি কূটনীতিকরা চাইলে টাকার বিনিময়ে চৌকস আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নের মাধ্যমে সড়কে চলাচলে নিরাপত্তা নিতে পারেন।
তিনি বলেন, যখন দেশে জঙ্গিদের উত্থান হয়েছিল, আমাদের এখানে অগ্নি-সন্ত্রাসের একটা রাজত্ব হয়েছিল। তখন চারটি দূতাবাসকে রোড প্রটেকশন দিতাম। এটা লিখিতভাবে দেওয়া হয়নি। তারাও আমাদের অনুরোধ করেনি। আমরাই তাদের দিয়েছিলাম, যাতে তারা কোনো রকম অসুবিধায় না পড়ে। আমরা চারটি দূতাবাসের বাইরে কাউকে দেইনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপি সদরদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে সকারের মন্ত্রণালয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ডিএমপির ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি ডিভিশন দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকদের নিরাপত্তা, তাদের বাসভবন কিংবা স্কুল-ক্লাবেও নিরাপত্তা দিয়ে আসছে। সব দূতাবাসে নিরাপত্তা আগের মতোই থাকবে, শুধুমাত্র এসকর্ট সুবিধা হিসেবে বাড়তি নিরাপত্তা সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাতিল করা হবে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. মনজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে কূটনীতিকদের শুধুমাত্র ‘বাড়তি নিরাপত্তা’ দেওয়া হবে না। তবে অন্য যে নিরাপত্তা তা সব বহাল থাকবে। কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় দীর্ঘদিন ধরে ডিএমপির সদ্যসরা সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।