রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্যে ছাত্রলীগ নয় বরং ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের ক্যাডারদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৪১ জনকে চাকরি দিতে কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকার লেনদেনে সদ্যবিদায়ী উপচার্য (ভিসি) অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান এ নিয়োগ সম্পন্ন করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এসব ঘটনায় ভিসির কঠোর শাস্তি দাবি জানিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ক্ষমতাসীন ও বাম দলের নেতাকর্মীরা।
জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গত বুধবার ১৪১ জনকে নিয়োগ দেন বিদায়ী ভিসি অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান। নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করতে রেজিস্ট্রার আব্দুস সালামকে চাপ প্রয়োগ করেন তিনি। রেজিস্ট্রার এমন অনিয়মের সঙ্গে আপস না করায় তার বাসায় গাড়ি পাঠিয়ে জোরপূর্বক তুলে আনার অপচেষ্টা চালান ভিসি। তবে তার আগেই নিজ বাসা ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেন রেজিস্ট্রার আব্দুস সালাম। ফলে তার স্বাক্ষর হয়নি নিয়োগপত্রে। সর্বশেষ উপাচার্যের নির্বাহী আদেশে সংস্থাপন শাখার উপ-রেজিস্ট্রার মো. ইউসুফ আলী নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করেন এবং নিয়োগ সম্পন্ন হয়।
এ প্রসঙ্গে রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অবৈধ এ নিয়োগ প্রক্রিয়ার সব কিছু প্রস্তুত করা হয় আগে থেকেই। অবৈধ নিয়োগ কার্যক্রম ও সরকারি নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত হতে চাইনি। তাই উপাচার্য ডাকলেও সেখানে উপস্থিত হইনি। বরং নিজ বাসা থেকে বের হয়ে অজ্ঞাত জায়গায় চলে যাই। কারণ বাসায় থাকলে তুলে এনে স্বাক্ষর করানো হতো।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫ মে রাতে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কিছু ‘ত্যাগী নেতাকর্মী’ নিয়োগ দেয়ার কথা বলা হলেও সিংহভাগই নিয়োগ পেয়েছেন ছাত্রদল ও শিবিরের ক্যাডাররা। অধ্যাপক সোবহানের নিজের জেলা নাটোর ও তার মেয়ে-জামাতার জেলা বগুড়ার লোকজন বেশি চাকরি পেয়েছেন। নিয়োগ তালিকায় রয়েছেন রাজশাহীর চার সাংবাদিকও। এছাড়া বিশ^বিদ্যালয়ে ভিসিপন্থি কিছু শিক্ষকের সন্তান ও আত্মীয়স্বজন পেয়েছেন চাকরি। এমনকি ভিসির পারিবারিক নাপিত, মালি ও কাঠমিস্ত্রিকেও চাকরি দেয়া
হয়েছে। লেনদেন হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা।
সূত্র জানায়, ১৪১ জনের নিয়োগ হতে লেনদেন হয়েছে অন্তত ৫ কোটি টাকা। যেটির মোটা অঙ্ক গেছে আব্দুস সোবহানের পকেটে। এ নিয়োগের আরো তিন হোতা পেয়েছেন টাকার ভাগ। তারা হলেনÑ সংস্থাপন (কর্মকর্তা) শাখার প্রধান ইউসুফ আলী, পরিষদ শাখার কর্মকর্তা মামুন-অর রশীদ ও রেজিস্ট্রার শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার তারিকুল ইসলাম।
রাবিতে এমন নিয়োগ এবারই প্রথম নয়। ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বহুল আলোচিত ৫৪৪ জনকে একটি অফিস আদেশে নিয়োগ দিয়েছিলেন তৎকালীন উপাচার্য ড. ফাইসুল ইসলাম ফারুকী। নিয়োগপ্রাপ্তদের অধিকাংশই ছিলেন বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল ও শিবিরের ক্যাডার। এমনকি সেই নিয়োগ তালিকায় উঠেছিল মৃত ব্যক্তির নামও। এ নিয়ে একাধিক মামলা হয় আদালতে। তবে শেষ পর্যন্ত নিয়োগপ্রাপ্তরা শুধু দিনভিত্তিক মজুরিতে কাজ করেন। তাদের মধ্যে ২৪৪ জন এখনো নিয়মিত বা স্থায়ী হতে পারেননি। এবারো ১৪১ নিয়োগের ক্ষেত্রে টাকা-পয়সার বড় লেনদেনের আলোচনায় সরব রাজশাহীর বিভিন্ন মহল। দাবি উঠেছেÑ স্বচ্ছভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন এবং এমন কর্মকাÐের জন্য বিদায়ী ভিসিকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করার।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রাজশাহী মহানগর ইউনিটের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মো. আব্দুল মান্নান ভোরের কাগজকে বলেন, ‘বিদায়ী ভিসি জঘন্য কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোকজনকে বঞ্চিত করে স্বাধীনতাবিরোধীদের চাকরি দিয়েছেন। সেটিও করেছেন মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে। অবশ্যই তার কঠোর শান্তি হওয়া উচিত। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা বলেছেন, অধ্যাপক আবদুস সোবহান কাউকে তোয়াক্কা করেননি। নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে এমন নিয়োগ দিয়েছেন, যা কোনোভাবেই বৈধ নয়। ইংরেজি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘উপাচার্য কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করা মানুষ। তিনি লিগ্যাল, মোরাল, কনটেক্সচুয়াল কোনো ইস্যুকে বিবেচনা করেননি।
নিয়োগ তালিকায় দেখা যায়, অ্যাডহকের মাধ্যমে নয়জন শিক্ষক, ২৩ জন কর্মকর্তা, ৮৫ জন নি¤œমান সহকারী এবং ২৪ জন সহায়ক কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। নিয়োগে ছাত্রলীগের কথা বলা হলেও ১৪১ জনের তালিকায় বিশ^বিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেকসহ আশপাশের বিভিন্ন শাখা ছাত্রলীগের ৪৩ জনের বেশি নেতাকর্মীর নাম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এ ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গতকাল শনিবার (৮ মে) সকালে রাজশাহীতে আসে। তদন্ত দলের প্রধান ইউজিসির সদস্য ও রুয়েটের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর ছাড়াও এ দলে রয়েছেন ইউজিসির সদস্য প্রফেসর ড. মো. আবু তাহের, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. মো. জাকির হোসেন আখন্দ ও ইউজিসির পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমান। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাবি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন তারা। বিশ^বিদ্যালয় সূত্র জানায়, এদিন দুপুরে রাবির রুটিরকালীন ভিসি অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহার কার্যালয়ে যায় তদন্ত দল। সেখানে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার প্রফেসর আব্দুস সালামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ওই দলের সদস্যরা। এ সময় সেখানে অন্য কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। বিভিন্ন তথ্য নেয়ার পর তারা বেরিয়ে আসেন।
পরে গাড়ি পাঠিয়ে সাবেক ভিসি অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানকে ক্যাম্পাসে আনা হয় এবং তাকে প্রশাসন ভবনে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় তদন্ত টিমের সদস্যরা তার কাছ থেকে নিয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য জানতে চান।
ঘণ্টাব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাইরে আসেন সাবেক ভিসি। এ সময় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসাবাদ প্রসঙ্গে কথা বলেন অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান। তিনি বলেন, ‘আমি তদন্ত টিমের কাছে বলেছি, এ নিয়োগ যৌক্তিক। নিয়োগ না হলে বিশ^বিদ্যালয় মুখ থুবড়ে পড়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হতো। এছাড়া চাকরিপ্রত্যাশীদের চাপও ছিল। যদিও ‘মানবিক’ কারণে বিশেষ ক্ষমতাবলে এদেরকে নিয়োগ দিয়েছি, কারো কোনো চাপে নয়।’ তবে ১৪১ জনের মধ্যে মাত্র ৪৫ জন ছাত্রলীগ নেতা নিয়োগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন অভিযোগ সত্য নয়। ছাত্রলীগ নেতা ছাড়াও আওয়ামী পরিবারের সন্তান, ক্ষমতাসীন দলের অনেক কর্মীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।’