বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নেতৃত্বে গঠিত কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি থেকে বিনামূল্যে টিকা পাচ্ছে বাংলাদেশ। এর বাইরেও জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) মাধ্যমে জোটটি থেকে আরো সাড়ে ১০ কোটি ডোজ টিকা ক্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোভ্যাক্সের শিগগিরই একটি চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে। চুক্তির আওতায় এসব টিকা কিনতে বাংলাদেশের ব্যয় হবে ৬ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করেছে। টিকার মূল্যসংক্রান্ত বিষয়ে সম্প্রতি অর্থ বিভাগের মতামতও চেয়েছিল স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। এরই মধ্যে চুক্তির অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে অর্থ বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের জন্য কোভ্যাক্সের ৭ কোটি ৫০ লাখ ১০ হাজার ৮০০ ডোজ সিনোভ্যাক ও ২ কোটি ৯৭ লাখ ২২ হাজার ৮০০ ডোজ সিনোফার্মের টিকা বরাদ্দ রয়েছে। এ টিকা ক্রয়ের জন্য ইউনিসেফ থেকে একটি খসড়া চুক্তি পাঠানো হয়েছে। এতে টিকার পাশাপাশি প্রয়োজনীয়সংখ্যক সিরিঞ্জ ও সেফ নিডল ডিসপোজাল বক্স ক্রয়ের কথাও বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতি ডোজ টিকার দাম পড়ছে সাড়ে ৫ মার্কিন ডলার। সাড়ে ১০ কোটি ডোজ টিকা, সিরিঞ্জ, সেফ নিডল ডিসপোজাল বক্স, বীমা ও পরিবহন বাবদ এ টিকা ক্রয় কার্যক্রমে মোট ব্যয় হবে ৭৪ কোটি ৭২ লাখ ৬৮ হাজার ৬৩৫ ডলার। বাংলাদেশ মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩৬৮ কোটি ১৭ লাখ ২২ হাজার টাকা (প্রতি ডলার সমান ৮৫ টাকা ২২ পয়সা ধরে)।
বিশ্বব্যাপী সবার টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিতে ডব্লিউএইচওর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি। জোটের সদস্য দেশগুলোকে বিনামূল্যে নির্দিষ্টসংখ্যক টিকা পাঠাচ্ছে কোভ্যাক্স। এর মধ্যে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের জন্য টিকা পাঠাচ্ছে জোটটি। এ অনুযায়ী দুই ডোজ মিলিয়ে মোট ৬ কোটি ৮০ লাখ টিকা পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। এরই মধ্যে বাংলাদেশকে মডার্না ও ফাইজার-বায়োএনটেক, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং সিনোফার্মের ১ কোটি ৩২ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশকে পাঠিয়েছে কোভ্যাক্স। এ অনুযায়ী জোটটি থেকে প্রতিশ্রুত টিকার আরো সাড়ে ৫ কোটি ডোজের বেশি টিকা বিনামূল্যে পাওয়ার কথা রয়েছে বাংলাদেশের।
এর বাইরেও কোভ্যাক্স থেকে টিকা ক্রয়ের সুযোগ রয়েছে। এ নিয়ে ডব্লিউএইচওর সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের একাধিকবার যোগাযোগ হয়েছে। বর্তমানে কোভ্যাক্স থেকে চীনা সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের টিকা ক্রয়ের চুক্তির বিষয়টি শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, চলতি বছর ও আগামী বছরের শুরুতে ব্যাপকসংখ্যক মানুষকে টিকা দিতে হলে বিপুল পরিমাণ টিকা প্রয়োজন। তবে এখনই সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের বাইরে অন্যান্য টিকা প্রাপ্তির বিষয়ে নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এ মুহূর্তে টিকা দুটির বিকল্পও নেই। এছাড়া এ টিকা ক্রয়ের ক্ষেত্রে ইউনিসেফের সহায়তা পাচ্ছে বাংলাদেশ।
এ টিকা ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ডোজ সাড়ে ৫ ডলার হিসেবে ৭ কোটি ৫০ লাখ ১০ হাজার ৮০০ ডোজ সিনোভ্যাকের দাম ধরা হয়েছে ৪১ কোটি ২৫ লাখ ৫৯ হাজার ৪০০ ডলার। একই মূল্যে ২ কোটি ৯৭ লাখ ২২ হাজার ৮০০ ডোজ সিনোফার্মের টিকার দাম ধরা হয়েছে ১৬ কোটি ৩৪ লাখ ৭৫ হাজার ৪০০ ডলার। প্রতিটি ৬ সেন্ট করে ১১ কোটি ৫২ লাখ ৭০০টি সিরিঞ্জের দাম ধরা হয়েছে ৬৯ লাখ ১২ হাজার ৪২০ ডলার। প্রতি বক্স ৮৪ সেন্ট ধরে ১১ লাখ ৫২ হাজার ৭৫টি সেফ নিডল ডিসপোজাল বক্সের দাম ধরা হয়েছে ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭৪৩ ডলার। এছাড়া আকাশপথে এসব টিকা আনতে পরিবহন ও বীমা বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ১১ কোটি ৬ লাখ ৪৩ হাজার ৭২২ কোটি ডলার। সরবরাহ খরচ ধরা হয়েছে ১ কোটি ৭৬ লাখ ৭৫ হাজার ৫২ ডলার। সব মিলিয়ে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৭৪ কোটি ৭২ লাখ ৬৮ হাজার ৬৩৫ ডলার।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একক একটি দেশের সঙ্গে টিকা ক্রয়ের বিষয়ে চুক্তি হলে সেখানে অপ্রত্যাশিত সমস্যা হতে পারে। এদিক থেকে কোভ্যাক্স থেকে ক্রয়ের চুক্তি হলে তাতে সমস্যা দেখা দেয়ার ঝুঁকি কম। এ সুবিধার জন্য কোভ্যাক্সের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি নিয়ে এগিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, প্রথমে সেরামের সঙ্গে করোনার টিকা কেনার চুক্তি করে বিড়ম্বনায় পড়েছে সরকার। এরপর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি করার চেষ্টা করা হয়। কিছু হয়েছেও। তবে তাতে টিকার সম্পূর্ণ সংস্থান হবে না। কোভ্যাক্সের মাধ্যমে অনুদানের বাইরে কেনার সুযোগ রয়েছে। তা কাজে লাগালে টিকাপ্রাপ্তিতে সমস্যা হওয়ার কথা না। কোভ্যাক্সের সঙ্গে টিকা কেনার চুক্তি হলে তাতে লাভবান হওয়া যাবে।
দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সেক্ষেত্রে টিকার আওতায় আসছে ১৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। এজন্য প্রতিজনকে দুই ডোজ করে দিতে হলে ২৭ কোটি ৬০ লাখ ডোজ টিকা প্রয়োজন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘কোভিশিল্ড’ টিকা হাতে নিয়ে গণটিকা কার্যক্রম শুরু করে সরকার। তবে চুক্তি অনুযায়ী পর্যাপ্ত টিকার সরবরাহ করতে পারেনি সেরাম। এতে দেশের টিকা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে চীনের সঙ্গে সাত কোটি ডোজ সিনোফার্মের টিকা ক্রয়ের চুক্তি করেছে সরকার। এরই মধ্যে কয়েক দফায় টিকাও পাঠিয়েছে চীন। এছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে স্পুতনিক-৫ টিকা ক্রয়ের চুক্তির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। দেশে জরুরি প্রয়োগের জন্য মোট আটটি টিকার অনুমোদন দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এর মধ্যে দেশে সিনোফার্ম, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগ চলছে। এ পর্যন্ত দেশে ক্রয়, উপহার ও কোভ্যাক্সের মাধ্যমে মোট টিকা এসেছে ৪ কোটি ৪৬ লাখ ডোজ।
সরকারের করোনার টিকাবিষয়ক তথ্য বলছে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩ কোটি ৬২ লাখ ডোজ টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২ কোটি ১৮ লাখ ৫১ হাজার ব্যক্তি প্রথম ডোজ ও ১ কোটি ৪৩ লাখ ৯০ হাজার ব্যক্তি দ্বিতীয় ডোজের টিকা পেয়েছেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, আমরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছি। টিকাও পাচ্ছি। কোভ্যাক্স বিনামূল্যে টিকা দিচ্ছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১৬ থেকে ১৭ কোটি ডোজ টিকার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে। এর পরও প্রায় ১০ কোটি ডোজের বেশি টিকা প্রয়োজন। এতে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে।