বিদ্যুৎ খাত: কুইক রেন্টালে লুটপাট ও ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা

ইসমাইল আলী: বিদ্যুৎ খাতের যে অনিয়মটি নিয়ে গত এক দশক ধরে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো কুইক রেন্টালের নামে লুটপাট। পাশাপাশি ক্যাপাসিটি চার্জের নামে গুটি কয়েক কোম্পানির হাতে হাজার হাজার কোটি টাকা চলে যাওয়ার বিষয়টিও সাম্প্রতিক সময়ে সামনে এসেছে। তবে গত জুলাইয়ে ঘোষণা দিয়ে আনুষ্ঠানিক লোডশেডিং শুরুর পর থেকে এ দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা আরও জোরালো হয়েছে। গণমাধ্যমগুলোয় উঠে আসতে শুরু করে এ দুই খাতের নানা অনিয়ম ও লুটপাটের চিত্র।

কুইক রেন্টাল ও ক্যাপাসিটি চার্জ বিদ্যুৎ খাতে কীভাবে বোঝা হয়েছে, কীভাবেই বা এগুলো দুর্নীতি ও লুটপাটকে উৎসাহিত করেছে তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এ লেখায়। এখন প্রথমেই দেখা যাক, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কোনগুলো। এরপর দেখব ক্যাপাসিটি চার্জ কী? কেনই বা সরকার ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে? কারা ও কেন পাচ্ছে- এ ক্যাপাসিটি চার্জ? পাশাপাশি দেখানো হবে কুইক রেন্টালের নামে লুটপাটের সংক্ষিপ্ত চিত্র।

১. ধরলাম, দেশের কোনো একটি কোম্পানি ‘এক্স’, ‘ওয়াই’ বা ‘জেড’ একটা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করল, যার জন্য ব্যয় হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। ৩ বছরের জন্য ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হলো। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নামে পরিচিত। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণব্যয় ৩০০ কোটি টাকা হলেও সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিনিয়োগ লেগেছে মোট ব্যয়ের ২৫-৩০ শতাংশ বা মাত্র ৭৫ থেকে ৯০ কোটি টাকা, যাকে ইক্যুইটি ইনভেস্টমেন্ট বলা হয়। বাকি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নেয়া হয়।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) তথা সরকার সুদসহ সেই ঋণ (চুক্তি অনুযায়ী) ৩ বছরে শোধ করে দেয়। পাশাপাশি ইক্যুইটি ইনভেস্টমেন্টের ওপর দেয়া হয় মুনাফা (রিটার্ন অব ইক্যুইটি)। এভাবে প্রতি বছর সরকার যে টাকা পরিশোধ করেছে, সেটাই ক্যাপাসিটি চার্জ।

মজার বিষয় হলো, সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণব্যয় শোধ করে দিলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রটা ওই কোম্পানিরই রয়ে যায়। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এমনটি দেখা যায় না। পার্শ্ববর্তী দেশ কোনো কোম্পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের লাইসেন্স নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে। এরপর তারা দরপত্র তথা বিড আহ্বান করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রির জন্য। সেখানে সরকার বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান/সংস্থা বা বিনিয়োগকারী যে কেউ বিড করতে পারে। যে সর্বোচ্চ দর অফার করে তার সঙ্গেই চুক্তি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।

আবার অনেক সময় ক্রেতা নিজেও নির্দিষ্ট পরিমাণ (যেমন: ৫০০ বা ১ হাজার মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করে থাকে। তখন বিদ্যুৎ বিক্রেতা বিভিন্ন কোম্পানি তাতে অংশ নেয়। আর যে কোম্পানি সবচেয়ে কম দর প্রস্তাব তার সঙ্গে চুক্তি করা হয়। এ ধরনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় রিভার্স অকশন। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বলা হয় মার্চেন্ট পাওয়ার প্লান্ট।

ভারতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হলেও তা নির্ভর করে কোম্পানির রিটার্ন অন ইক্যুইটির ওপর। আর তা নির্ধারণ করে দেয় দেশটির কর্তৃপক্ষ সিইআরসি (সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশন)। পাঁচ বছর পরপর বাজার পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে এ হার পুনর্নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে দেশটিতে রিটার্ন অন ইক্যুইটির হার ১৪-১৫.৫ শতাংশ। তবে এটি কমিয়ে ১২ শতাংশ করার চিন্তাভাবনা চলছে। যদিও বাংলাদেশে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রিটার্ন অন ইক্যুইটি নির্দিষ্ট না। কোম্পানিভেদে তা ওঠানামা করে। যেমনÑরামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রিটার্ন অন ইক্যুইটি ধরা হয়েছে ১৮ শতাংশ। আবার পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে এ হার ১৬ শতাংশ।

ভারতে প্রায় সবগুলো মার্চেন্ট পাওয়ার প্লান্ট। তবে আমাদের দেশে মার্চেন্ট পাওয়ার প্লান্ট আছে মাত্র একটি। ইউনাইটেড পাওয়ার চট্টগ্রামে এ ধরনের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে, যার উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরাসরি চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) কাছে বিক্রি করা হয়। যদিও এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য ভর্তুকি মূল্যে গ্যাস সরবরাহ করছে সরকার। ফলে প্রচুর মুনাফা করছে কোম্পানি। আর দেশের বেসরকারি খাতে অনুমোদন দেয়া ১০০-এর বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাকি সবই রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বা আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার)। আইপিপিগুলো অনেকটা বড় আকারের রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। আকারে বড় ও চুক্তির মেয়াদ বেশি (১৫/২২/২৫ বছর) হলেও পরিচালনার ধরন একই রকম।

২. এখন আসি ক্যাপাসিটি চার্জের আলোচনায়। সরকার তিন বছরে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণব্যয় পরিশোধ করে দিলেও বিষয়টা এখানেই শেষ হয়নি। বরং লুটপাট আরও বাকি রয়েছে।

ধরলাম লাইসেন্স দেয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১০ হাজার ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা)। কিন্তু চুক্তিকালীন সময়ে (৩ বছরে) এর ৩০ শতাংশ ব্যবহার হয়। এতে মেয়াদশেষে ওই কোম্পানি আবেদন করে চুক্তি নবায়ন করতে। কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা অবশিষ্ট রয়ে গেছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওই কোম্পানির সঙ্গে আরও দুই বছরের চুক্তি করা হয়। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণব্যয় যে পরিশোধ করা হয়ে গেছে সেটি বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়। এতে নতুন করে আবারও ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়।

পরবর্তী দুই বছরে ওই কেন্দ্রের সক্ষমতার আরও হয়তো ২০ শতাংশ মানে দুই হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা ব্যবহার হয়। তখন ওই কোম্পানি আবার আবেদন করে চুক্তি নবায়নের। তখন হয়তো পাঁচ বছরের জন্য চুক্তি নবায়ন করা হয়। সে সময়ও ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়। তবে পরিমাণে কিছুটা কমিয়ে দেয়া হয়। আর ওই সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতার আরও ৩০ শতাংশ ব্যবহার হয়। তখন ওই কোম্পানি আবার আবেদন করে এবং আবার চুক্তি নবায়ন হয় দুই বছরের জন্য। পুনরায় তাকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়।

এভাবেই ৩ বছরের বিদ্যুৎকেন্দ্র ১২ বছর ধরে চলে। তবে ১৫-১৭ বছর পর্যন্ত চলবে কিছু রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চারবার বিক্রি করে চার দফা ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে যায় ওই কোম্পানি। এভাবে নামমাত্র বিনিয়োগ করেও ৫০০-৬০০ কোটি টাকা বা তারও বেশি কামিয়ে নেয়া হয়। এই হলো বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবসা ও কুইক রেন্টালের নামে লুটপাটের ব্যাখ্যা।

৩. পিডিবির তথ্যমতে, গত ১৪ বছরে বেসরকারি খাতে প্রায় ১০০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র দরপত্রের মাধ্যমে নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। যদিও ওই দরপত্রে একটিমাত্র কোম্পানি অংশ নেয়। ফলে তাতেও কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। এতে বেশি দরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের লাইসেন্স পায় সামিট গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। তবে বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর লাইসেন্স দেয়ার আগে কোনো ধরনের দরপত্রই আহ্বান করা হয়নি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল আনসলিসিটেড তথা অযাচিত প্রস্তাব যাচাইয়ের মাধ্যমে। এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জও নির্ধারণ করা হয় দরকষাকষির (নেগোসিয়েশন) মাধ্যমে। ফলে এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি ধরা হয়েছে।

৪. এবার দেখা যাক, গত ১৪ বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকার কতটা ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ খরচ করল। পিডিবির হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১৪ বছরে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপিগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় প্রায় ৮৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ অলমোস্ট তিনটি পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয়ের সমান অর্থ গেছে এ খাতে। যদিও এ সময় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হয়নি। এমনকি কোনো কোনো বছর সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হয়নি। অথচ বসিয়ে রেখেই প্রতি বছরই ক্যাপাসিটি চার্জের পুরোটা পরিশোধ করা হয়।

পিডিবির তথ্য বলছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছর তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ আরও বেড়ে হয় ২ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছর তা এক লাফে ৫ হাজার কোটি টাকায় ওঠে। এরপর কয়েক বছর ক্যাপাসিটি চার্জ ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার ঘরেই ছিল। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় পৌনে ৯ হাজার টাকা।

২০১৯-২০ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ তা অনেকটাই বেড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছায়। ২০২০-২১ অর্থবছর তা আরও বেড়ে অতিক্রম করে ১৩ হাজার কোটি টাকা। আর সর্বশেষ অর্থবছর (২০২১-২২) তা দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জের বৃদ্ধির এ ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে বলে প্রাক্কলন করেছে পিডিবি। চলতি অর্থবছর তা ১৫ হাজার কোটি টাকা ছুঁতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।

৫. এত গেল সরকার কত টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করল তার হিসাব। এবার দেখা যাক, ক্যাপাসিটি চার্জের কতটা কোন কোম্পানির পকেটে ঢুকেছে। এ তালিকায় গত কয়েক বছর ধরে শীর্ষে রয়েছে দেশের সামিট গ্রুপ। গত ১৪ বছরে সামিটের পকেটে ক্যাপাসিটি চার্জ ঢুকেছে প্রায় ১০ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা, যা মোট ক্যাপাসিটি চার্জের প্রায় ১২ শতাংশ।

ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ের তালিকায় ২য় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল। গত ১৪ বছরে কোম্পানিটির জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে ৭ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা, যা এ খাতে ব্যয়ের প্রায় ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ৩য় অবস্থানে রয়েছে মালয়েশিয়াভিত্তিক চীনা কোম্পানি এরদা পাওয়ার হোল্ডিংসের। ১৪ বছরে এরদা পাওয়ার ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে ৭ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা, যা এ খাতে ব্যয়ের ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে সার্বিকভাবে চতুর্থ তবে দেশীয় কোম্পানির মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইউনাইটেড গ্রুপ। সব মিলিয়ে ১৪ বছরে গ্রুপটি ৬ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে, যা মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। পরের (৫ম) অবস্থানে রয়েছে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল)। ১৪ বছরে এ কোম্পানির পকেটে গেছে ৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, যা মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ।

ষষ্ঠ অবস্থানে থাকা বাংলা ক্যাট গ্রুপ ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে পাঁচ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। এরপরই রয়েছে বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে গড়ে ওঠা পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র। যদিও মাত্র সোয়া দুই বছর আগে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদন শুরু করেছে। তবে এ সময়ের মধ্যেই কেন্দ্রটির জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।

দেশীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে চতুর্থ অবস্থানে থাকা ওরিয়ন গ্রুপ সার্বিকভাবে তালিকায় রয়েছে অষ্টম অবস্থানে। তাদের ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ ৪ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। ৯ম অবস্থানে থাকা খুলনা পাওয়ার কোম্পানি (কেপিসিএল) ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে ৪ হাজার ৫৪ কোটি টাকা। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানির ৩৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সামিট গ্রুপের কাছে ও ৩৫ শতাংশ ইউনাইটেড গ্রুপের কাছে। বাকি ৩০ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। অর্থাৎ এ কোম্পানির আদায়কৃত ক্যাপাসিটি চার্জের বড় অংশই গেছে সামিট ও ইউনাইটেডের কাছে।

ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে পরের অবস্থানগুলোয় রয়েছেÑদেশীয় হোসাফ গ্রুপ (১০ম), মোহাম্মদী গ্রুপ (১১তম), ডরিন গ্রুপ (১২তম) ও ম্যাক্স গ্রুপ (১৩তম)। এ চার গ্রুপের ক্যাপাসিটি চার্জ যথাক্রমে ২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা, ২ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা, ২ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা ও ২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। এর পরের অবস্থানগুলোর মধ্যে ১৪তম যুক্তরাষ্ট্রের এপিআর এনার্জি ও ১৫তম সিঙ্গাপুরের সেম্বকর্প। এ দুই কোম্পানির ক্যাপাসিটি চার্জ যথাক্রমে ২ হাজার ৮৭ কোটি টাকা ও ২ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। তবে সেম্বকর্পের মালিকানার ২৯ শতাংশের রয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির কাছে।

তালিকায় পরের অবস্থানে থাকা কোম্পানিগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ ২ হাজার কোটি টাকার নিচে। এর মধ্যে দেশীয় শাহজিবাজারের (১৬তম) ক্যাপাসিটি চার্জ ১ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা, সিকদার গ্রুপের (১৭তম) ১ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা ও কনফিডেন্স গ্রুপের (১৮তম) ১ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। ১৯তম অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিউ ইংল্যান্ড পাওয়ার কোম্পানির এনইপিসি কনসোর্টিয়ামের হরিপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ কোম্পানিটি ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে ১ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি শেষ হয় ২০১৮ সালে। ২০তম অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ কোম্পানি লক্ষধনভি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। এ কোম্পানিটি ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে ১ হাজার ৪০১ কোটি টাকা।

ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে ২১-২৫তম অবস্থানে থাকা কোম্পানির সবগুলো দেশীয়। এরা হলোÑসিনহা গ্রুপ, আনলিমা গ্রুপ, বারাকা গ্রুপ, রিজেন্ট গ্রুপ ও এনার্জিপ্যাক। এ পাঁচ কোম্পানি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, ১ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, ১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা, ১ হাজার ৩৭ কোটি টাকা এবং ১ হাজার ২৭ কোটি টাকা। আরও কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে তবে তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ের পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকার কম।

৬. দেশি-বিদেশি এসব কোম্পানি ছাড়াও ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে গিয়ে ৯ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা। দেশটি থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয় ২০১৩-১৪ অর্থবছর। সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল প্রায় ৫০১ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছর আমদানি বাড়ায় ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে দাঁড়ায় ৯২২ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছর কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৮৪০ কোটি টাকা। তবে ২০১৬-১৭ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৬৮ কোটি টাকা।

২০১৭-১৮ অর্থবছর বিদ্যুৎ আমদানি কিছুটা বাড়ে সঙ্গে ক্যাপাসিটি চার্জও। ওই অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি আরও বৃদ্ধিতে চুক্তি হয়। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছর ১ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছর ১ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা।

ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি কমবেশি হলেও ক্যাপাসিটি চার্জ কমার সুযোগ নেই। এভাবেই বিদ্যুৎ খাতে চলছে কুইক রেন্টালের নামে দুর্নীতি আর ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বাড়ছে অর্থের অপচয়।

সুত্রঃ- দৈনিক শেয়ার বিজ, প্রকাশ- ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১