আন্তর্জাতিক ডেস্ক: গাজায় প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। এর আওতায় জীবিত সব ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তি পাবেন এবং হামাসের কাছে থাকা নিহতদের মরদেহ হস্তান্তর করা হবে। বিনিময়ে তাদের কারাগারে বন্দি থাকা অনেক ফিলিস্তিনিকে মুক্তি এবং সম্মত লাইন পর্যন্ত সেনা প্রত্যাহার করবে ইসরায়েল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) ঘোষণা দেন, মিসরে চলমান শান্তি আলোচনা বৈঠকে তার প্রস্তাবিত গাজা শান্তি পরিকল্পনার এই পর্যায়ে স্বাক্ষর করেছে দুই পক্ষ। ট্রাম্প বলেন, ‘হামাসের হাতে বন্দি সব জিম্মিকে দ্রুত মুক্তি দেয়া হবে এবং ইসরায়েল একটি সম্মত লাইন পর্যন্ত সেনা প্রত্যাহার করবে। এটি স্থায়ী শান্তির প্রথম পদক্ষেপ’।
টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, ফিলিস্তিনি উপত্যকাটিতে হামাসের হাতে থাকা জিম্মির ৪৮ জন ইসরায়েলির ২০ জন জীবিত আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সোমবার (১৪ অক্টোবর) জীবিত সব জিম্মি মুক্তি পাবেন এবং নিহতদের মরদেহ হস্তান্তর করবে হামাস।
ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনার সঙ্গে দুই পক্ষ একমত হয়েছে বলেও জানিয়েছে আল জাজিরা। কাতারভিত্তিক গণমাধ্যমটি বলছে, গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার ও বন্দি বিনিময় ছাড়াও মানবিক সহায়তা প্রবেশের শর্তে এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুদ্ধবিরতির এই ধাপ মানবিক সাফল্য হলেও গাজার স্থায়ী শান্তি নির্ভর করছে পরবর্তী আলোচনার ওপর। চুক্তির বাস্তবায়ন এখনও চ্যালেঞ্জের মুখে। প্রথম ধাপে জিম্মি মুক্তি ও সেনা প্রত্যাহার থাকলেও গাজার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতির নিশ্চয়তা নিয়ে এই অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে বলেও ধারণা তাদের।
‘জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে যুদ্ধবিরতি’ চুক্তির দিনটিকে ‘বিশ্বের জন্য মহান দিন’ বলেও মন্তব্য করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। বুধবার (৮ অক্টোবর) বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া সংক্ষিপ্ত টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে পুরো বিশ্ব এক হয়েছে। ইসরায়েলসহ সব দেশ একসঙ্গে এসেছে। আজকের দিনটি অসাধারণ। এটি বিশ্বের জন্য মহান এবং সবার জন্য দারুণ ও আনন্দের দিন’।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেন ট্রাম্প। ট্রুথ সোশ্যালের পোস্টে তিনি লেখেন, ‘আমি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করছি, ইসরায়েল ও হামাস-উভয়ই আমাদের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ের বাস্তবায়নে রাজি হয়েছে। খুব শিগগিরই সব জিম্মিকে মুক্তি দেয়া হবে। সেই সঙ্গে ইসরায়েল নিজেদের সেনাদের নির্ধারণ করা একটি সীমানায় সরিয়ে আনবে’।
এদিকে এ ঘোষণা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে ট্রাম্প গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, মিসরে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলা যুদ্ধবিরতি আলোচনায় আলোচকেরা চূড়ান্ত চুক্তির ‘খুব কাছাকাছি’ পৌঁছেছেন। চুক্তি হলে সেটি ঘোষণা দিতে মিসরে যাবেন তিনি।
পরে হোয়াইট হাউস জানায়, ওয়াশিংটনের ওয়াল্টার রিড মেডিকেল সেন্টারে শুক্রবার (১০ অক্টোবর) সকালে পূর্বনির্ধারিত স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অংশ নেবেন ট্রাম্প। এরপর মিসরে যেতে পারেন তিনি। সেটি শনিবার (১১ অক্টোবর) কিংবা রোববার (১২ অক্টোবর) হতে পারে।
যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা নিয়ে দুই পক্ষ সম্মত হওয়ার পর ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তার দপ্তরের বিবৃতিতে জানানো হয়, এটি ‘ইসরায়েলের জন্য একটি দারুণ দিন’।
নেসেটে (ইসরায়েলের পার্লামেন্ট) ভাষণ দিতে ট্রাম্পকে আমন্ত্রণও জানিয়েছেন নেতানিয়াহু । বৃহস্পতিবারই এ পরিকল্পনার অনুমোদন দিতে পারে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা।
এদিকে যুদ্ধবিরতি চুক্তির খবরে গাজার তরুণরা সকাল থেকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাস্তায় নেমে নেচে-গেয়ে ও স্লোগান দিয়ে উদযাপন করছেন।
২৯ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ বন্ধে ২০ দফা প্রস্তাব দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তির বিনিময়ে সব ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি, যুদ্ধবিরতি, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং গাজার পুনর্নির্মাণ ও ত্রাণ সহায়তা প্রবেশসহ স্থায়ী শান্তির এই পরিকল্পনায় ইতিবাচক সাড়া ও সম্মতি দেয় ইসরায়েল ও হামাস।
সোমবার (৬ অক্টোবর) থেকে মিসরের পর্যটন শহর শারম আল শেখে ইসরায়েল ও হামাসের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা চলছে। বৈঠকে কাতার, তুরস্ক, মিসরসহ মধ্যস্থতাকারীরা ট্রাম্পের ২০ দফার পুরোটাই যেন দুই পক্ষ মেনে নেয়, সেজন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও।
মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ট্রাম্পকে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেশটিতে সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। শান্তিচুক্তির জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে ও শর্ত মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বনেতারাও।
জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যান্তেনিও গুতেরেস সব পক্ষকে এ চুক্তির সব শর্ত মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এই দুর্ভোগের অবসান হওয়া উচিত।’
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার বিবৃতিতে, ‘এটি গভীর স্বস্তিকর মুহূর্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ বিবৃতিতে বলেছেন, ‘দুবছরেরও বেশি সময় ধরে সংঘাত, জিম্মি এবং বেসামরিক মানুষের প্রাণহানির পর, চুক্তিটি শান্তির দিকে একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। আমরা সকল পক্ষকে পরিকল্পনার শর্ত মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি।’
ইসরায়েলের দাবি, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে হাজার ২১৯ জনকে হত্যা ও ২৫১ জনকে জিম্মি করে হামাস। ওই দিন থেকেই গাজায় টানা ভয়াবহ নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, গত দুই বছরে ইসরায়েলের হামলায় এ উপত্যকায় ২০ হাজার ১৭৯ জন শিশুসহ ৬৭ হাজার ১৮৩ জন নিহত ও অন্তত এক লাখ ৬৯ হাজার ৮৪১ জন আহত হয়েছেন। একই সময়ে ইসরায়েলি-সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টিতে অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে মারা গেছেন ৪৫৫ জন, যাদের ১৫১ জনই শিশু।