এক সপ্তাহে ট্যারিফ সমস্যার সমাধান না হলে বন্দর বন্ধের হুঁশিয়ারি

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন ট্যারিফ সমস্যার সমাধান না হলে বন্দর বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে চট্টগ্রাম পোর্ট ইউজার্স ফোরাম। বন্দরে প্রবেশ ও গেটপাস ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে এবং স্টেকহোল্ডারদের ডেকে বন্দরের ট্যারিফ শিডিউল পুননির্ধারণের দাবিতে কঠোর আন্দোলনে নামার কথাও জানিয়েছেন ফোরামের সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী।

তিনি বলেছেন, ‘যে সরকার আমেরিকা গিয়ে ট্যারিফ কমায়, সেই সরকার বন্দরে ট্যারিফ বাড়ায়’। ট্রেইলার ধর্মঘট শুরু হয়েছে, আমাদের কনটেইনার যাবে না’।

১৪ অক্টোবর থেকে ট্রাক, ট্রেইলার, বাসসহ ভারী গাড়ির বন্দরে প্রবেশ ফি ৫৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৩০ টাকা করার পাশাপাশি গেটপাস ও অন্যান্য লাইসেন্স চার্জও ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ বাড়িয়েছে বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ। এর প্রতিবাদে ওই দিন বিকেল থেকেই কনটেইনার পরিবহনের প্রাইম মুভার, ট্রেইলার ও লং ভ্যাহিক্যাল চালাচ্ছেন না মালিকরা। ফলে কিছু কিছু জায়গায় ডিপোর ট্রেইলার চলাচল চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। খালাস না হওয়া কনটেইনারও জমে যাচ্ছে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরটিতে। ফলে বড় ধরনের অচলাবস্থা তৈরির শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন রোববার (১৯ অক্টোবর) থেকে চার ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করবে। কর্মবিরতিতে যাচ্ছে আরো দুটি সংগঠনও।

শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুরে চট্টগ্রাম নেভি কনভেনশন হলে চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন সেবায় ‘অযৌক্তিক ও অতিরিক্ত ট্যারিফ আরোপের’ প্রতিবাদে সভা করেছে পোর্ট ইউজার্স ফোরাম।

ফোরামের সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী সভায় বলেন, ‘আমরা গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। সেখান থেকে আনঅফিশিয়ালি জানানো হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের কর্মসূচির কারণে তিনি মনোযোগ দিতে পারছেন না। তাই আমরা এ প্রতিবাদ সভা করছি। এরপরও মনোযোগ দেওয়া না হয় তাহলে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বেশিদিন আর অপেক্ষা করবেন না। আমরা আজকে আবারও সরকারকে আরেকটা স্মারকলিপি দেব এগুলো জানিয়ে। এক সপ্তাহের মধ্যে যদি এটার সমাধান করা না হয়, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ করে দেওয়া হবে’।

এ কর্মসূচিতে সারাদেশের ব্যবসায়ীরা একাত্মতা জানাবেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি কিন্তু শুধু চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের জন্য নয়, সারাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য, জনগণের জন্য। কারণ, এই টাকা যাবে জনগণের পকেট থেকে।’

সভায় স্বাগত বক্তব্যে সাধারণ সম্পাদক এম এ সালাম বলেন, ব্যবসায়ীরা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। ৮৫ শতাংশ আমদানি রপ্তানি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হয়। বন্দরের নতুন ট্যারিফে ব্যবসায়ীরা ইনসিকিউরড ফিল করছেন। আমি বিশ্বাস করি, আমরা সমস্বরে না বললে সমাধান হবে না। চট্টগ্রাম বন্দর সেবাকেন্দ্র, লসে নেই। আড়াই-দিনে হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। তাহলে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে কেন এত কারসাজি। ট্রেইলার ধর্মঘট শুরু হয়েছে, আমাদের কনটেইনার যাবে না। স্টেক হোল্ডারদের দেখে বন্দরের ট্যারিফ শিডিউল পুননির্ধারণ করার দাবি জানাই’।

বন্দর সূত্র জানায়, নতুন ট্যারিফে দৈনিক অস্থায়ী গেট পাস ফি (জনপ্রতি) মূল ফি ১০০ টাকার সাথে ১৫ টাকা ভ্যাট যোগ করে মোট ১১৫ টাকা, ভারী যানবাহন প্রবেশ ফি (ট্রাক, ট্রেইলার, বাস ইত্যাদি) মূল ফি ২০০ টাকার সাথে ৩০ টাকা ভ্যাট যোগ করে মোট ২৩০ টাকা, হালকা যানবাহন প্রবেশ ফি (মাইক্রোবাস, কার, জিপ) মূল ফি ১২০ টাকার সাথে ১৮ টাকা ভ্যাট যোগ করে মোট ১৩৮ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া ছোট যানবাহন প্রবেশ ফি (অটোরিকশা, মোটরসাইকেল) এর মূল ফি ১০০ টাকার সাথে ১৫ টাকা ভ্যাট যোগ করে মোট ১১৫ টাকা, স্থায়ী গেট পাস ফি মূল এক হাজার ১৫০ টাকার সাথে ১৭২.৫০ টাকা ভ্যাট যোগ করে মোট এক হাজার ৩২২.৫০ টাকা এবং স্থায়ী গেট পাস হারানো, স্থায়ী গেট পাস বিলম্বে নবায়ন, জেটি সরকার লাইসেন্স ফি (প্রতি বছর), জেটি সরকার লাইসেন্স হারানো ফি ও জেটি সরকার লাইসেন্স বিলম্বে নবায়ন মূল ফি এক হাজার ১৫০ টাকার সাথে ১৭২.৫০ টাকা ভ্যাট যোগ করে মোট এক হাজার ৩২২.৫০ টাকা করা হয়েছে।

বিজিএমইএ’র পরিচালক এমডিএম মহিউদ্দিন বলেন, বন্দরে ট্যারিফ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড ঘটে গেছে। ঘর ভাড়া, দোকান ভাড়ার নীতিমালা আছে। বন্দরের নতুন ট্যারিফে ব্যবসায়ীরা প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, পরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ জানাই। আমেরিকার ট্যারিফ নিয়ে সুখে নেই আমরা। এর মধ্যে বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধি কাম্য নয়।

শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা অত্যন্ত কনসার্ন। বন্দর কোনো কোনো ক্ষেত্র ৪৪০ শতাংশ ট্যারিফ, চার্জ বাড়িয়েছে। পোর্ট লিমিট বাড়ানোর সময় ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে। পাইলটিং, পোর্ট ডিউজ দিতে হচ্ছে। কস্ট বেইজড ট্যারিফ হওয়া উচিত। শিপ ওনার চার্জ বাড়িয়ে দেবে। শিল্প বাণিজ্য ক্ষেত্রে অচলাবস্থা তৈরি হবে। আমাদের শেষ ভরসা প্রফেসর ইউনূস। ট্যারিফ বাড়াতে হলে স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে বাড়াতে হবে।

বন্দর ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির সোহেল বলেন, আমাদের ১২ হাজার গাড়ি আছে বন্দরে। বন্দরের উন্নতির পেছনে আমাদের কিছু ভূমিকা আছে। ২-৩ হাজার টাকায় ট্রিপ মেরে ৫০০ টাকা আয় হয় না, আমার ওপর ৩০ হাজার টাকা আয়কর। বন্দরের নতুন ট্যারিফ শিডিউলে ৫৭ টাকার গেইট পাস ২৩০ টাকা করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ও ফ্লাটবেড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, বন্দর ৫৭ টাকার পাসের ফি ২৩০ টাকা করেছে। বন্দরে চালকদের ওয়াশ রুম, ক্যান্টিন নেই। আমাদের ১৫ হাজার গাড়ি, ১০ হাজার শ্রমিক। বন্দর টার্মিনাল দিচ্ছে না ১৫ বছর বলার পরও। তিন ধরনের ট্যাক্স দিই। একজন মানুষ কতবার ট্যাক্স দেবে। এটা সংস্কার করা দরকার।

সঞ্চালক এসএম আবু তৈয়ব বলেন, ট্রাম্পের ট্যারিফে পৃথিবীতে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যে সরকার আমেরিকা গিয়ে ট্যারিফ কমায় সেই সরকার বন্দরে ট্যারিফ বাড়ায়। এতে দেশের ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। এ ট্যারিফ অযৌক্তিক মনে করি। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

বাফা’র পরিচালক অমিয় শঙ্কর বর্মণ বলেন, বন্দর ও অফডক একসঙ্গে ট্যারিফ, চার্জ বাড়িয়েছে তা অসহনীয়। কোনো ক্ষেত্রে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

বিপিজিএমইএ শহীদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, লুটপাট শুরু হয়েছে। ২০ ফুটের কনটেইনারে লোড আনলোডে ৬০ ডলার খরচ হচ্ছে। বেসরকারি পর্যায়ে আরও বেশি লুট হচ্ছে।

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, ব্যবসায়ীদের জন্য দুসংবাদ। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। বিদেশে ট্যারিফ কমাতে অন্তর্বর্তী সরকার সফল হয়েছে, ধন্যবাদ জানাই। বন্দর অর্থনীতির লাইফ লাইন। এটা শেষ করতে নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আমদানি রপ্তানিকারকের ব্যথা আমরা জানি। ১২ টাকার ফি ১১৫ টাকা করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাবে। নতুন ট্যারিফ কমানো না গেলে ব্যবসায়ীদের যাওয়ার জায়গা থাকবে না। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। সিঅ্যান্ডএফের ১৩ হাজার শ্রমিক কর্মচারী এ খরচের বোঝা নিয়ে কাজ করতে অপারগ।

সভায় বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক আমিরুল হক, শিপিং এজেন্টের শাহেদ সরওয়ার, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি, শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. পারভেজ আকতার, ডব্লিউটিসির সভাপতি মোহাম্মদ শফি, বিপণি বিতান ব্যবসায়ী সমিতির শারুদ নিজাম, টায়ার টিউব ইমপোর্টারস ও ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের মঈনুদ্দিন আহমেদ মিন্টু, মোহাম্মদ ইয়াসিন প্রমুখ।

—জা.অর্থনীতি/ এআর

Add Comment

Click here to post a comment

space for add

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১