সাইফুল আলম:দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ৯০ পয়সায় মিলছে পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার। বিষয়টি শুনতে বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্যি। গতকাল ডিএসইতে পিপলস লিজিংয়ের শেয়ারের সমাপনি দর ছিল ৯০ পয়সা, যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন শেয়ার দর। আগের দিন এ শেয়ারের দর ছিল ছিল এক টাকা।
ডিএসই সূত্র জানা যায়, ২০০৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সের প্রতিটি শেয়ারদর নিয়মিতই কমছে। গতকাল মাত্র ৯০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে এ শেয়ার। এর আগের চার কর্মদিবস শেয়ারটি এক টাকায় লেনদেন হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে কোম্পানিটির তার ৩০ জুন ২০২৫ সমাপ্ত তৃতীয় প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৬ টাকা ৬২ পয়সা। আগের বছর এই সময়ে শেয়ার প্রতি লোকসান ছিল ৫ টাকা ৭৪ পয়সা। তৃতীয় প্রান্তিক শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ (ঋণাত্মক) হয়েছে ১৫৮ টাকা ১২ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে শেয়ারপ্রতি সম্পদ (ঋণাত্মক) ছিল ১৪১ টাকা ৪৩ পয়সা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে ২২টি দেশীয় মালিকানাধীন। ১৩টি দেশি ও বিদেশি যৌথ মালিকানাধীন। এর মধ্যে উচ্চ খেলাপি ঋণ ও টাকা ফেরত দিতে না পারা ২০টি প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ করা হবে না তা জানতে চেয়ে নোটিশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ১১টি প্রতিষ্ঠান তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছে। বাকি ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের পক্ষ থেকেও এতে সায় এসেছে।
সূত্রমতে, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, আভিভা ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কম্পানি (বিআইএফসি), প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স এবং প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়। তবে এসব কোম্পানিগুলোর আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে তহবিল গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ খাতে বিপুল পরিমাণ লোকসান করায় পুরো খাতের সম্মিলিত লোকসান সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কর্মকর্তারা জানান, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় অবশেষে দেশের ৯টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পারা, ঋণের পাহাড়সম খেলাপি আর মূলধনের ঘাটতিতে ভেঙে পড়া এসব প্রতিষ্ঠানকে ‘অপরিচালনযোগ্য’ ঘোষণা করে অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেবে সরকার, আর কর্মচারীরাও চাকরিবিধি অনুযায়ী সুবিধা পাবেন। এসব নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে আলাপ-আলোচনা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, ফিন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২৩ অনুযায়ী লাইসেন্স বাতিল ও অবসায়নের প্রস্তুতি শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেজল্যুশন বিভাগ। হিসাব অনুযায়ী, সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের নিট ব্যক্তি আমানতের পরিমাণ প্রায় চার হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। অবসায়নের প্রাথমিক ধাপে এই অর্থের জোগান দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের বেশিরভাগই খেলাপি। এর মধ্যে এফএএস ফাইন্যান্সের ৯৯.৯৩ শতাংশ, ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ৯৮ শতাংশ, বিআইএফসির ৯৭.৩০ শতাংশ এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ৯৬ শতাংশ ঋণ খেলাপি। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং একাই খেলাপি ঋণ জমিয়েছে তিন হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা, যার বেশির ভাগই আদায় অযোগ্য। পিপলস লিজিংয়ের খেলাপি ঋণের হার ৯৫ শতাংশ এবং লোকসান চার হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। আভিভা ফাইন্যান্সের খেলাপি ৮৩ শতাংশ, লোকসান তিন হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৭৫ শতাংশ ঋণ খেলাপি, লোকসান ৯৪১ কোটি টাকা। এরমধ্যে জিএসপি ফাইন্যান্সের খেলাপি ৫৯ শতাংশ, লোকসান ৩৩৯ কোটি টাকা। প্রাইম ফাইন্যান্সের ৭৮ শতাংশ ঋণ খেলাপি, লোকসান ৩৫১ কোটি টাকা।
বর্তমানে ২০ প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ২১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। খেলাপির হার দাঁড়িয়েছে ৮৩.১৬ শতাংশ। এ অবস্থায় ফিন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২৩-এর ৭(১) ধারা অনুযায়ী লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী আমানতকারীর স্বার্থবিরোধী কার্যক্রম, দায় পরিশোধে সম্পদের ঘাটতি এবং মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থতার কারণে লাইসেন্স বাতিল করা যায়। একই আইনের ৭(২) ধারা অনুযায়ী লাইসেন্স বাতিলের আগে ১৫ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিতে হয়। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত ২২ মে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সন্তোষজনক জবাব না আসায় বাংলাদেশ ব্যাংক চূড়ান্তভাবে অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তৎকালীন মালিক-পরিচালকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে পিপলস লিজিং থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেন। এতে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদনে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠানটিকে লিকুইডেশনে পাঠালে সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তবে ২০২১ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে কোম্পানিটি পুনরায় চালু করা হয়।






Add Comment