রাফায়েত ফেব্রিক্স লিমিটেড

২৫৯৫ মেট্রিক টন কাপড় গায়েব, ৯৭ কোটি টাকা শুল্ককর ফাঁকি

প্রধান প্রতিবেদক: অবশেষে বন্ড কমিশনারেটের ঘুম ভেঙ্গেছে। সেই জালিয়াত বন্ডেড প্রতিষ্ঠান রাফায়েত ফেব্রিক্সের অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ২ হাজার ৫৯৫ মেট্রিক টন বন্ড সুবিধার কাপড় খুঁজে পায়নি কর্মকর্তারা। যার ফলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রায় ৯৭ কোটি টাকার শুল্ককর ফাঁকির মামলা করেছে। যদিও অনুসন্ধান বলছে, মাত্র এক বছরে প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধায় ৪ হাজার ৯২৭ মেট্রিক টন কাপড় আমদানি করেছে। যার মধ্যে ৩ হাজার ৭৯৭ মেট্রিক টন কাপড় প্রতিষ্ঠানটি খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। অর্থাৎ প্রতিমাসে গড়ে ৩১ কন্টেইনার কাপড় ‘সিঅ্যান্ডএফ ও দালালের’ মাধ্যমে খালাস করে তা বিক্রি করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এই নিয়ে ১৬ নভেম্বর ‘রাফায়েত ফেব্রিক্স লিমিটেড-বন্ডের ৪৯২৭ টন কাপড়ের ৩৭৯৭ টন-ই বিক্রি করে দিয়েছে!’-শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই নিয়ে এনবিআর, কাস্টম হাউসসহ সংশ্লিষ্ট জায়গায় তীব্র সমালোচনা হয়। যার প্রেক্ষিতে ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট যাচাই শুরু করে। পরে অনিয়ম পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তবে বন্ড কমিশনারেট মামলা করে দায় সেরেছে। কিন্তু বন্ড সুবিধার এসব কাপড় যেসব সিঅ্যান্ডএফ ও দালাল কাস্টমস কর্মকর্তাদের ঘুষের মাধ্যমে খালাস করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বন্ড কমিশনারেটের মামলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাভারের বিরুলিয়া খাগান এলাকার প্রতিষ্ঠান রাফায়েত ফেব্রিক্স লিমিটেড। ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট বন্ড লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটিকে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহিৃত করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি সরেজমিন পরিদর্শন করেন বন্ড কর্মকর্তারা। পরিদর্শনে প্রতিষ্ঠানটির ইউডিভিত্তিক অনুমোদিত পোশাকের জন্য আমদানি করা ফেব্রিক্স, রপ্তানি করা পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত ফেব্রিক্সের মজুদ ও অবৈধ অপসারণের তথ্য পাওয়া যায়। দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটিকে বিজিএমইএ থেকে সাতটি ইউডিতে ৭৮ লাখ ৬৪ হাজার ৩৯৩ পিস পোশাক রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৭৮২ কেজি ফেব্রিক্স আমদানি করেছে। আর এই ফেব্রিক্স দিয়ে পোশাক তৈরি করে রপ্তানি করেছে ৩০ লাখ ১১ হাজার ৩৪৪ পিস। রপ্তানি করা এই পোশাকে ব্যবহৃত ফেব্রিক্সের পরিমাণ ১৫ লাখ ৩৯ হাজার ৫৫৫ কেজি। আর পরিদর্শনকালে প্রতিষ্ঠানটির ওয়্যারহাউসে পাওয়া গেছে ৩ লাখ ১৫ হাজার ৬২২ কেজি ফেব্রিক্সস। বাকি ২৫ লাখ ৯৪ হাজার ৬০৫ কেজি বা ২ হাজার ৫৯৫ মেট্রিক টন ফেব্রিক্স পাওয়া যায়। অর্থাৎ এই ফেব্রিক্স প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। অবৈধভাবে অপসারণ করা এই ফেব্রিক্সের প্রযোজ্য শুল্ককর ৯৭ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার ৪৯৮ টাকা, যা প্রতিষ্ঠানটি ফাঁকি দিয়েছে। তবে অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠানটি ৩ হাজার ৯৯৭ মেট্রিক টন ফেব্রিক্সস বা কাপড় প্রতিষ্ঠানটি খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। অবৈধভাবে বন্ড সুবিধার কাপড় খোলাবাজারে বিক্রি করায় প্রতিষ্ঠানকে ১৭ নভেম্বর ১০ দিনের সময় দিয়ে দাবিনামাসহ কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে।

একাধিক সূত্রমতে, প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারক পোশাক প্রতিষ্ঠানকে ইউডি দেয় বিজিএমইএ। রাফায়েত ফেব্রিক্স লিমিটেড মাত্র এক বছর আগে বন্ড লাইসেন্স পেয়েছে। বিরুলিয়ায় একটি ১০ তলা ভবনে রাফায়েত গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ভবনে নিয়ম করে পোশাক তৈরির সব মেশিনারিজ রয়েছে। কিন্তু কোন উৎপাদন হয় না। নতুন প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রামে এক সিঅ্যান্ডএফ নেতা জামাল উদ্দিন বাবলুর মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে কাস্টমসে ঘুষের মাধ্যমে প্রতিমাসে অন্তত ৩১ কন্টেইনার কাপড় আমদানি করেছে। যা ইসলামপুরের দালাল খুরশিদ আলমের মাধ্যমে জাকির, জাহাঙ্গীর, শাহীন ও কাইয়ুমের কাছে সরাসরি বিক্রি করে দেয়। প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানি নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। একটি নতুন প্রতিষ্ঠান, যারা বন্ড সুবিধার কাপড় দিয়ে কোনো পণ্য তৈরি না করে সরাসরি বিক্রি করে, তাদেরকে বিজিএমইএ কোন যাচাই ছাড়াই কিভাবে ইউডি ইস্যু করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে বিজিএমইএ এর একটি চক্র অসাধু উপায়ে এসব ইউডি দিয়েছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সূত্র আরও জানিয়েছে, সংবাদ প্রকাশের পর প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম ঘা ঢাকা দিয়েছেন। তবে বন্ড কমিশনারেট প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেই দায় সেরেছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানকে যেসব কর্মকর্তা যাচাই ছাড়াই বন্ড লাইসেন্স দিয়েছে, এক বছরে এত কাপড় আমদানি করে সরাসরি বিক্রির সঙ্গে যেসব বন্ড কর্মকর্তা জড়িত-তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি খুরশিদ আলম নামের যে দালাল ইসলামপুর থেকে কন্ট্রাক্টে এলসি নিতো, সিঅ্যান্ডএফ নেতার মাধ্যমে কন্ট্রাক্টে ঘুষ দিয়ে কাপড় খালাস করতো, তাতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যেসব কর্মকর্তা-তাদের বিরুদ্ধে এনবিআর, বন্ড কমিশনারেট ও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ব্যবস্থা না নিলে একই ধরনের অসাধু প্রতিষ্ঠান এই ধরনের কাজ করতে উৎসাহ পাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

Add Comment

Click here to post a comment

space for add

 

আর্কাইভ