রাজিয়া সুলতানা তূর্ণা, বিশেষ প্রতিনিধি: অন্যের জমি দখল করে উটের খামার করার অভিযোগ উঠেছে দেওয়ানবাগ শরীফের পীরের সন্তানদের বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে তাদের ‘অপকর্মের’ বিষয়ে সব কিছু জেনে যাওয়া ও তাদের কাছে পাওনা অর্থ দাবি করায় বিপাকে পড়েছেন বলে অভিযোগ শরিয়তুল্লাহ বিপ্লব নামে এক ব্যক্তির। নিজেকে তিনি দেওয়ানবাগ শরীফের মুরিদ সন্তান বলে দাবি করছেন। বলছেন, তাকে দেওয়ানবাগে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তাকে ও তার স্ত্রীকে মারধর ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
ওদিকে দেওয়ানবাগের ছেলেরা দাবি করছেন, টাকা পয়সা নিয়ে কিছু ঝামেলার কারণে তাদের বাবাই এই মুরিদকে বিদায় করে দিয়েছিলেন। যাতে দেওয়ানবাগ শরীফে না ঢুকতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। তবে, আদালতের নির্দেশনা নিয়ে বিপ্লব কয়েকবারই দেওয়ানবাগে ঢুকেছেন।
অথচ শরিয়তুল্লাহ বিপ্লবের অভিযোগ, দেওয়ানবাগ শরীফের সন্তানদের বিভিন্ন অপকর্ম, জমি দখল সম্পর্কে জানতে পারা ও পাওনা টাকা দাবি করার কারণে বিভিন্ন সময়ে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাকে। এছাড়াও হত্যার হুমকিসহ মোর্শেদ দেওয়ানবাগের স্ত্রীর মাজার জিয়ারতেও বাধার মুখে পড়তে হয়।
পরে মতিঝিল থানা পুলিশের সহযোগিতায় মাজার জিয়ারত করেন তিনি। একই সঙ্গে নিজের জীবনের নিশ্চয়তা চেয়ে থানায় একটি লিখিত সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন শরিয়তুল্লাহ বিপ্লব।
তিনি বলেন, ২০১৪ সাল থেকে দেওয়ানবাগ শরীফের ছেলেদের দ্বারা অনেক অত্যাচারিত হয়ে আসছি। আমি এই দরবার শরীফে যখন বিশ্বাস করি তখনতো তারা আমাকে যা বলে আমি তাই বিশ্বাস করেছি। তারা যা বলেছে আমি তাই করেছি। এদের কারণে আমি প্রতারিত হয়েছি।
দেওয়ানবাগ শরীফ পীরের ছেলেদের ‘ভণ্ড’ আখ্যা দিয়ে বিপ্লব বলেন, ছেলেরা ভণ্ড কিন্তু দেওয়ানবাগ শরীফ হুজুর ভণ্ড না। তাকে ভণ্ড বানিয়ে দিয়েছে তারই ছেলে মেয়েরা। আমি তাদের অনেক কিছু জানি।
১৯৯২ সাল থেকে এই পরিবারের সাথে ও দরবার শরীফের সঙ্গে জড়িত উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছি একজন চাকর হিসেবে। সেই সুবাদে আমি হুজুরকে বাবাজান এবং তার স্ত্রীকে দয়াল মা জান বলে ডাকি। তারাই আমাকে বিয়ে দিয়েছেন।
জমি দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে বিপ্লব বলেন, আমি মে মাসের ৮ তারিখে জানতে পারি এই জমির মালিক আমাদের বাবাজান (দেওয়ানবাগ শরীফ হুজুর) না। এই জায়গার মালিক আব্দুল গফুর। তিনি ২০১৬ সালে মারা গিয়েছেন। তিনি আমাকে ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর খবর আমি জানতাম না। কারণ দেওয়ানবাগ শরীফ হুজুরের ছেলেদের অত্যাচারে তখন আমি নিজের জীবন রক্ষা করার জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম।
‘আমি যদি সত্যিকারের আল্লাওয়ালা হয়ে থাকি তাহলে আমি অন্যদের জায়গা দখল করবো কেনো?’ এমন প্রশ্ন করে তিনি বলেন, এই জন্য আমি নিজে থেকে একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি এই জমির মালিক মো. আব্দুল গফুর। পীরের আস্তানা দেওয়ানবাগ শরীফের পাশেই সেই জমিতে উটের খামার করা হয়েছে। যার দাগ নং ৮৪১, ৮৪৩ খতিয়ান নং ৬৪।
আব্দুল গফুরের দেওয়া-পাওয়ার মূলে নিজেকে এই জায়গার দাবিদার উল্লেখ করেন শরীয়তুল্লাহ বিপ্লব। আর সে কারণেই পীরের ছেলেমেয়েরা তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বলেই দাবি তার।
বিপ্লব বলেন, ২০০৯ সালে পীরের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এই পরিবারের সন্তানদের সাধ্যমত সহায়তা করে আসছেন। তাদের লেখাপড়াসহ বিভিন্ন কাজে খরচ করেছেন। যার মোট অংক তিন কোটি টাকার বেশি বলে দাবি তার। এই অর্থ তার পাওনা দাবি করে বিপ্লব বলেন, এসব খরচের বিভিন্ন ভাউচার, নথি এবং তথ্য তার কাছে রয়েছে।
এসব পাওনা টাকা চাওয়া, দরবারের নজরানার চাঁদা এবং মাজারে পাশে দখল করা আব্দুল গফুরের জমিতে উটের খামার নিয়ে কথা বলার কারণে বিপ্লবকে সেখানে যেতে নিষেধ করেন পীরের ছেলেরা। তার অভিযোগ একপর্যায়ে তিনি সেখানে গেলে তাকে মারধর করা হয়। দরবারে যাওয়ার সময় তার স্ত্রীকেও শারীরিক নির্যাতন করা হয়। সেখান থেকে প্রাণে বেঁচে আসলেও তারপর থেকে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
২০১৪ সাল থেকে তাকে মাজারে ঢুকতে দেওয়া হয় না জানিয়ে বিপ্লব বলেন, এরপরও আমি মাঝেমধ্যে লুকিয়ে দরবারে গিয়ে মাজার জিয়ারত করেছি।
২০২৩ সালের শেষের দিকে আদালতে যান তিনি। আদালতে নির্দেশনা নিয়ে ২০২৪ সালে সেখানে যাওয়ার সুযোগ পান কয়েকবার। কিন্তু তারপরেও আমার স্ত্রী ও আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আসছে। আমি ভয়ে পালিয়ে এবং লুকিয়ে লুকিয়ে থাকি, বলেন শরিয়তুল্লাহ বিপ্লব।
বিষয়টি লিখিতভাবে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ডিএমপি কমিশনারকে জানিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাকে হুমকি-ধমকি, মারধর ও হত্যা চেষ্টার ঘটনাসহ মাজারে ঢুকতে না দেওয়ার কারণে এর আগেও মামলা দায়ের করেছি।
তার কথায়, দেওয়ানবাগ পীরের ছোট ছেলে মঞ্জুরে খোদার পালিত সন্ত্রাসী এ আর এস আরিফুর রহমান ও নিয়াজ মনসুর শাওন ছাড়াও আরও নাম না জানা অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা তার ওপরে হামলা চালায়।
গত ৮ মে মোর্শেদ দেওয়ানবাগর স্ত্রীর ৬৭তম জন্মদিনে তার মাজারে যেতে চাইলে তাকে বাধা দেওয়া হয়। পরে মতিঝিল থানা পুলিশের সহায়তার মাজার জিয়ারত করেন।
জমি দখলের বিষয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয় মৃত গফুরের ছেলে মাইদুল ইসলাম মিন্টুর সাথে। তিনি বলেন, আমার বাবার জমি দেওয়ানবাগ শরীফের ছেলেরা দখল করে রেখেছে। এটা নিয়ে কোর্টে মামলা চলছে। সব ডকুমেন্টস (দলিল-পত্র) কোর্টে পেশ করেছি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দেওয়ানবাগ শরীফের ছোট ছেলে এ. এফ. এম মঞ্জুরে খোদা ওরফে ছোট হুজুর (পরশ) বার্তা২৪.কমকে বলেন, দরবারে আশার জন্য শরিয়তুল্লাহ বিপ্লব কোর্টে একটা লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। কোর্টের থেকে একটা রায়ও নিয়েছিলেন। কিন্তু আমার বাবা বেঁচে থাকতেই টাকা পয়সা রিলেটেড কিছু ঝামেলা করার কারণে বাবা তাকে দরবার থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। বাবা বলেছিলেন সে যেনো আর না আসতে পারে। এই জন্য তাকে আমরা এখানে আসতে বাধা দিতাম। কিন্তু সে কোর্টের অর্ডার নিয়ে এখনও মাঝে মধ্যে আসে।
জমি দখলের বিষয়ে তিনি বলেন, দখলের বিষয়টা তেমন কিছু না। এটা নিয়ে কোর্টে একটা কেস চলছে। রায় হলে যাদের পক্ষে রায় যাবে তারাই জমি পাবে।