ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের প্রায় ৭৯ শতাংশই ব্যবসায়ী বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
আজ রোববার (৯ মে) রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। ‘৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে হলফনামা বিশ্লেষণ ও চূড়ান্ত ফলাফল’ শীর্ষক এক আয়োজনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
টিআইবি জানায়, স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে তিনটি পদের ভোটে ১ হাজার ২১০ জন নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে ৯৩০ জনই নতুন মুখ। তাদের মধ্যে ২৭৯ জন জনপ্রতিনিধি রয়েছেন যারা ৫ম উপজেলা পরিষদে ছিলেন।
টিআইবি আরও জানায়, দেশে উপজেলার সংখ্যা ৪৯৫টি। এবার চারধাপে উপজেলা পরিষদ ভোটের ঘোষণা দিয়েছিল কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন। তবে ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে কমিশন তা আর করতে পারেনি৷ চারধাপে ৪৪২ উপজেলায় ভোট শেষ করে কমিশন। আজ রোববার ১৯ উপজেলায় স্থগিত নির্বাচনের ভোট হচ্ছে। সবমিলিয়ে ৪৬১ উপজেলায় ভোট শেষ হবে আজ। আইনি জটিলতা ও মেয়াদ শেষ না হওয়ায় বাকি ৩৪ উপজেলায় ভোট হবে পরে। ভাইস চেয়ারম্যান পদে নবনির্বাচিত মুখ ৩১৭ জন। বিগত ৫ম উপজেলা পরিষদে ছিলেন ৬৫ জন। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩১০ জন নতুন মুখ। ৮৪ জন নারী ভাইস চেয়ারম্যান রয়েছে যারা গত উপজেলায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।
টিআইবির তথ্য অনুযায়ী ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনে তিন পদে মোট প্রার্থী ৫ হাজার ৪৭২ জন প্রার্থী ছিলেন। চেয়ারম্যান পদে ১ হাজার ৮৬৪ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২ হাজার ৯৫জন এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে অংশগ্রহণ করেছেন ১ হাজার ৫১৩ জন।
আইন অনুযায়ী, দলীয় প্রতীকে ভোটের বিধান থাকলেও নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলগতভাবে কোনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি। তবে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী। ভোটে মন্ত্রী এমপিদের স্বজনদের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশনা থাকলেও দলীয় নিয়ম অমান্য করে ৫৪ জন স্বজন অংশ নিয়েছেন। এছাড়া বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে মোট ১৩১ উপজেলায় নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এতে বহিষ্কৃত হয়েছেন ২০১ জন।
টিআইবি জানায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ জাতীয় নির্বাচনের তুলনায়ও কম। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নারী প্রার্থী ছিলেন মাত্র ৭৬ জন যার মধ্যে ১৪ জন জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন। নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেশি; নারী ভাইস চেয়ারম্যানদের অধিকাংশ নিম্ন মাধ্যমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছেন।
জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচনের সকল ধাপে ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট অক্ষুণ্ণ রয়েছে বলে মনে করে টিআইবি। টিআইবির তথ্যমতে, নির্বাচিতদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের হার ৫ বছরে বেড়েছে ৬.৫ শতাংশ; চেয়ারম্যানদের প্রায় ৭৯ শতাংশই ব্যবসায়ী।
নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৫০.৯৬ শতাংশ নিজেকে গৃহিণী/গৃহস্থালি কাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। গৃহিণী/গৃহস্থালিকে পেশা হিসেবে দেখানো প্রার্থীদের ১৫.৬৮ শতাংশের আয় আসে ব্যবসা থেকে। ১৫.৭৯ শতাংশ প্রার্থীর কোনো না কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নির্বাচিতদের ক্ষেত্রে এ হার ২০ শতাংশ।
সার্বিকভাবে প্রার্থীদের প্রায় ৪০ শতাংশ আয় দেখিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে, অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন ১০ শতাংশ প্রার্থী।
চেয়ারম্যান ও অন্যান্য প্রার্থীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য আয় বৈষম্য লক্ষ্য করা গেছে বলেও জানায় টিআইবি।
চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২৩ শতাংশের আয় ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার ওপরে, অন্যান্য প্রার্থীর ক্ষেত্রে এ হার ৩.০৩ শতাংশ। আবার, চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২১ শতাংশের আয় সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে, অন্যান্য প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৫০.২৫ শতাংশ।
বছরে ১০ লাখ টাকা আয় করেন এমন নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যা ২৮০ জন। চেয়ারম্যানদের ৫১ শতাংশ বছরে ১০ লাখ টাকা আয় করেন। বছরে ১ কোটি টাকা আয় করেন এমন নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যা ৪০। এর মাঝে ২ জন ভাইস চেয়ারম্যান আর বাকি সবাই চেয়ারম্যান।
৭.১৩ শতাংশ বা ৩৯০ প্রার্থীর কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে। ৫ বছরে প্রায় তিন গুণের বেশি হয়েছে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা। নির্বাচিতদের ১৫০ জন বা ১২.৩৭ শতাংশ কোটিপতি; চেয়ারম্যানদের ১৩২ জন বা ৩০.৪১ শতাংশ কোটিপতি।
প্রায় ২৪.৪ শতাংশ বা ১৩৩৫ জন প্রার্থীর ঋণ/দায় রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৫২৮.৯১ কোটি টাকা ঋণ/ দায় রয়েছে একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর। গত নির্বাচনের তুলনায় প্রায় ৯ শতাংশ বেড়েছে দায় বা ঋণগ্রস্তের সংখ্যা; নতুন চেয়ারম্যানদের প্রায় ৪৪ শতাংশের বর্তমানে ঋণ আছে।
৫ বছরে একজন জনপ্রতিনিধির আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ৩১ হাজার ৯০০ শতাংশ; এ সময়ে জনপ্রতিনিধিদের স্ত্রী অথবা স্বামী ও নির্ভরশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৪০০ শতাংশ।
৫ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা পেছনে ফেলেছেন সংসদ সদস্যদের। একজন সংসদ সদস্যের অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধির হার ছিল সর্বোচ্চ ৩০৬৫ শতাংশ, যেখানে একজন চেয়ারম্যানের বেড়েছে ১১ হাজার ৬৬৬ শতাংশ।
৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদে একজন বিজয়ীর ৫ বছরে আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৮৬৬.৬৭ শতাংশ; অস্থাবর সম্পদ সর্বোচ্চ বেড়েছে ২৩ হাজার ৯৩৭.৬৫ শতাংশ। প্রায় ৮৪ শতাংশ প্রার্থীর হলফনামার সঙ্গে আয়কর রিটার্নের সম্পদের হিসেবের পার্থক্য দেখা যায়।
৫ বছরে ১ কোটি টাকার উপরে অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে এমন প্রার্থীর সংখ্যা ৫১ জন। ১০ বছরে এমন প্রার্থীর সংখ্যা ৪১ জন। দেশের মধ্যাঞ্চল, কুমিল্লা-ফেনী অঞ্চল ও খুলনা অঞ্চলে প্রার্থীদের গড় আয় ও অস্থাবর সম্পদ বেশি। বরিশাল, খুলনা, কুমিল্লা অঞ্চলে প্রার্থীদের গড় অস্থাবর সম্পদ ৫ বছরে বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গাজীপুর, ময়মনসিংহ অঞ্চলে।