১৯৭১ সালের ১ মার্চ হঠাৎ করে ইয়াহিয়া খানের ঘোষণায় ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করা হলো। আপামর জনতা বিদ্রোহ-ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসমাবেশে পতাকা উত্তোলন। ৩ মার্চ ঘোষণা হলো পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার, জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। বহুপ্রতীক্ষিত ৭ মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। অসহযোগ আন্দোলন, যুদ্ধের প্রস্তুতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা বাংলাদেশে।
২৫ মার্চ। সন্ধ্যা থেকে প্রতিরোধের প্রস্তুতি। সেই দুঃসময়ের স্মৃতিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে: আগুন জ্বলছে পলাশীর বস্তিতে, বিদ্রোহ ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে, দাউদাউ করে জ্বলছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। রাতের শেষ প্রহরে কামানের গর্জন। আগুনের ফুলকি চতুর্দিকে। সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার নির্দেশে, জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামের সামরিক অভিযানে সংঘটিত হয় ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। জাতিসংঘের ঘোষণায় ‘জেনোসাইড’-এর যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তবায়ন হয়েছে সেদিন বাঙালির ওপর। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানার তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল, জহুরুল হক হলসহ সারা ঢাকা শহরে তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ২৬ মার্চ সকালে ঢাকা থেকে বের করে দেওয়া হয় বিদেশি সাংবাদিকদের; যাতে করে কেউ গণহত্যার কোনো সংবাদ পরিবেশন করতে না পারেন।
আর্চার ব্লাডের লেখা দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ছাত্রীরা হল থেকে দৌড়ে বের হওয়ার সময় মেশিনগানের গুলি চালিয়ে তাঁদের হত্যা করা হয়েছিল। ২৬ মার্চ সকালের দিকে সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুম ও ৮৮ ইউনিটের মধ্যে যে কথোপকথন হয় তার রেকর্ড থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই অগণিত ছাত্রছাত্রী নিহত হয়েছিলেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নূরুল্লার ধারণকৃত ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ছাত্রদের দিয়েই জগন্নাথ হলের মাঠে গর্ত খোঁড়া হচ্ছে, আবার সেই গর্তেই ছাত্রদের লাশ মাটিচাপা দেওয়া হচ্ছে। অনেক ঘরবাড়ি ও পত্রিকা অফিস, প্রেসক্লাবে আগুন ধরিয়ে, কামান ও মর্টার হামলা চালিয়ে সেগুলো বিধ্বস্ত করা হয়। অগ্নিসংযোগ করা হয় শাঁখারীপট্টি ও তাঁতীবাজারের অসংখ্য ঘরবাড়িতে। ঢাকার অলিগলিতে, বহু বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। হত্যাকাণ্ড শুরুর প্রথম তিন দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও অন্যান্য শহরে লাখ লাখ নর-নারী ও শিশু প্রাণ হারায়। ঢাকার প্রায় ১০ লাখ ভয়ার্ত মানুষ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
২৫ মার্চের গণহত্যা ছিল জঘন্যতম গণহত্যার সূচনামাত্র। পরবর্তী ৯ মাসে ৩০ লাখ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা সৃষ্টি করেছিল সেই বর্বর ইতিহাস, নিষ্ঠুরতা এবং সংখ্যার দিক দিয়ে ইহুদি নিধনযজ্ঞ (হলোকাস্ট) বা রুয়ান্ডার গণহত্যাকেও অতিক্রম করে গেছে।
আমেরিকার সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ১৯৭১ সালে ভারতে শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যার অভিযোগ করেন। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ংকর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তাবিষয়ক আর্কাইভ’ তাদের অবমুক্তকৃত দলিল প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে সিলেক্টিভ জেনোসাইড বা জেনোসাইড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক ড্যান কগিন টাইম ম্যাগাজিন-এ এক লেখায় এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের উদ্ধৃতি প্রচার করেন: ‘আমরা যে কাউকে এবং যেকোনো কিছুকে হত্যা করতে পারি। কারও কাছে আমাদের কোনো জবাবদিহি করতে হবে না।’ আন্তর্জাতিক মহলের মতেও ১৯৭১ সালে ‘তিন মিলিয়ন’ বা ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। এই সংখ্যার সমর্থন আছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন, এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকানা ও কমটন্স এনসাইক্লোপিডিয়ায়। পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী নিজের ডায়েরিতে লেখেন, তিনি বাংলার সবুজ মাঠকে রক্তবর্ণ করে দেবেন। সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় ১৩ জুন ১৯৭১ প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট প্রকাশ করেন। পৃথিবীর মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। ৯ মাসে এত মানুষ হত্যা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়াই ছিল মুশকিল। একমাত্র খুলনার চুকনগরেই ২০ মে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।
আজ এত বছর পর হলেও আমরা উদ্যোগ নিয়েছি এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে একটি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসর জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্রসংগঠনসহ রাজাকার-আলবদর-আলশামস বিভিন্নভাবে বাংলার মাটিতে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। এই অপরাধের জন্য ১৯৭২ সালেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় সাড়ে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ১৫ আগস্টের পর তাদেরই মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল জিয়াউর রহমানের নির্দেশে। রাজাকারদের প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন এবং গণহত্যায় নিহত ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অবমাননাকর ও ন্যক্কারজনক ইতিহাসের জন্ম দেন। ইতিহাসের এই দায় থেকে জাতিকে মুক্ত করা, ইতিহাসকে শুদ্ধ করার প্রয়োজনেই শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ের সংগ্রাম।
সেই সংগ্রামের পথ ধরেই আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন, ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মের জন্য ইতিহাস ঢেলে সাজাচ্ছেন। সংবিধানের চার মূলনীতি প্রতিস্থাপন করেছেন। ৩০ লাখ শহীদ এবং ৩ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি যারা করেছে, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তাই আজকে জাতির সময় এসেছে এই গণহত্যার সব ঘটনার বিবরণীর সঙ্গে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যুক্ত করা। তারই ন্যায্যতার প্রয়োজন আজ।
২৫ মার্চ কালরাতের সেই ভয়াবহ নৃশংসতা এবং ৯ মাসের হত্যাযজ্ঞের বিবরণ জনসমক্ষে নিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন এই হত্যাযজ্ঞকে স্মরণ করে একটি দিবস পালন করা। একই সঙ্গে জাতীয়ভাবে দিনটি নির্ধারণ করে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়। একই সঙ্গে আজ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে ১৯৭১ সালের ১৯৫ জন পাকিস্তানি সৈন্যের বিচারের লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জনমত গঠন। প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা, সম্পদ ধ্বংস, লুণ্ঠনসহ নারী নির্যাতনের জন্য যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে, সেই ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ। পাকিস্তানের কাছে পাওনা সব অর্থসম্পদের হিস্যা আদায় করাও আজকে একটি কর্তব্য।
মানবতাবিরোধী অপরাধে যাদের বিচার হয়েছে, যাদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে, তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা। এসব কাজ সম্পন্ন করার প্রয়োজনেও জরুরি একটি দিবস পালন। শ্রমিক কর্মচারী মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার আন্দোলন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দল, ছাত্র-যুব-নারী সবার দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১১ মার্চ জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিনের সভাপতিত্বে দশম জাতীয় সংসদের ১৩তম অধিবেশনে ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে স্মরণ করে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হোক এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হোক’ প্রস্তাবটি সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭ ধারায় আমি উত্থাপন করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গণহত্যাসংক্রান্ত বিশেষ ভিডিও চিত্র ও স্থিরচিত্র প্রদর্শন করেন। বিরোধীদলীয় নেতাসহ ৫৬ জন সাংসদ ও মন্ত্রী এই প্রস্তাবের সমর্থনে ৭ ঘণ্টা যাবৎ আলোচনায় অংশ নেন। সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাবটি পাস হয়।
শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ্বমানবতার অগ্রযাত্রার স্বার্থেও অন্তত একটি দিন গণহত্যার মতো পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য নির্ধারিত থাকা প্রয়োজন। দিনটিকে ঘিরে গণহত্যার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক-সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে পৃথিবীর কোথাও আর কখনোই এ রকম গণহত্যার ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তাই ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্তটি ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।