আয়তনে ছোট এবং বেশ ঘনবসতিপূর্ণ হলেও বাংলাদেশ স্বাধীনতা–পরবর্তী ৫০ বছরে সীমিত সাধ্য নিয়েই অন্তত ১৩টি ক্ষেত্রে বিশ্বের দরবারে গৌরবোজ্জ্বল ও ঈর্ষণীয় অবস্থান তৈরি করেছে। এসব খাতে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকিগুলো কষ্ট করে অর্জন করতে হয়েছে।
এমন অবস্থান তৈরি করতে বাংলাদেশের সরকারগুলোর নীতি-সিদ্ধান্ত যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি উদ্যমী সাধারণ মানুষের অবদানও কম নয়। আবার উদ্যোক্তারা শত বিপত্তির মুখেও ব্যবসা–বাণিজ্য ও শিল্পকারখানা স্থাপনের মাধ্যমে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন বেসরকারি খাতনির্ভর অর্থনীতি। এভাবে সবার অবদানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে উত্থান ঘটেছে, তা আজ চোখ বড় করে দেখছে বিশ্ববাসী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চীন ও ভারতের মতো বড় দেশের পরেই উচ্চারিত হয় বাংলাদেশের নাম। কয়েকটি ক্ষেত্রে তো চীন-ভারতকে পেছনে ফেলে প্রথম অবস্থানে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বাংলাদেশ ব্যাংক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ১৩টি খাতে বিশ্বের শীর্ষ দশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান জানা গেছে।
ধান উৎপাদনে চতুর্থ
ধান থেকে চাল হয়, চাল থেকে ভাত। এ ভাতই বাঙালির প্রধান খাদ্য। স্বাধীনতার পর যখন মোট জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি, তখন দেশে খাদ্যসংকট ছিল। আমদানি করে চলতে হতো। অথচ সেই বাংলাদেশ কিনা আবাদি জমির পরিমাণ অনেক কমার পরও আজ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের হিসাবে, দেশে গত ২০১৯–২০ অর্থবছরে ৫ কোটি ২৬ লাখ টন ধান উৎপন্ন হয়েছে, যা বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ। চীন ১৪ কোটি ৮৫ লাখ টন উৎপাদন করে প্রথম, আর ভারত ১১ কোটি ৬৪ লাখ টন উৎপাদন করে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদ দিবস উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বর্তমান সরকারের কৃষি অনুকূল নীতি এবং প্রণোদনায় কৃষক ও কৃষিবিদদের মিলিত প্রচেষ্টা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে অবদান রাখছে। অধিক জনঘনত্বের এ দেশে জমি কমছে। তারপরও কৃষি উৎপাদনের বৃদ্ধি বিশ্বের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার।’
ইলিশে প্রথম
সারা বিশ্বে উৎপাদিত মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশই বাংলাদেশে হচ্ছে, যা পরিমাণে ৫ লাখ ৩৩ হাজার টন। তবে ইলিশ উৎপাদন ৭ লাখ টন হওয়াও সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। চার বছর আগেও বিশ্বে মোট ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশের হিস্যা ছিল ৬৫ শতাংশ। ইলিশ উৎপাদনে ভারত দ্বিতীয়, মিয়ানমার তৃতীয়। এ ছাড়া ইরান, ইরাক, কুয়েত, পাকিস্তানেও সামান্য ইলিশ উৎপাদন হয়।
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। গত ২০১৯–২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২ হাজার ৭৫০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা বিশ্বের মোট পোশাক রপ্তানির ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। পোশাক রপ্তানিতে প্রথম হচ্ছে চীন। তাদের হিস্যা ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ। ৬ দশমিক ২ শতাংশ হিস্যা নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে ভিয়েতনাম।
প্রবাসী আয়ে অষ্টম
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক কোটির বেশি বাংলাদেশি বসবাস করেন, যাঁদের বেশির ভাগই শ্রমিক। নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ তাঁরা দেশে পাঠান মা-বাবা, ভাইবোন, স্ত্রী-পুত্র-পরিজনদের কাছে। প্রবাসী আয় আহরণে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। গত অর্থবছরে দেশে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২ হাজার কোটি ডলার। একই অর্থবছরে ভারত ৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলার নিয়ে প্রথম এবং ৬ হাজার ৭০০ কোটি ডলার পেয়ে চীন দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
সবজিতে তৃতীয়
সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। বছরে উৎপাদন হয় ১ কোটি ৬০ লাখ টন। এ ক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থান চীনের, দ্বিতীয় স্থান ভারতের। বেসরকারি কোম্পানিগুলো সারা বছর চাষের উপযোগী হাইব্রিড বা উচ্চ ফলনশীল (উফশী) বীজ উদ্ভাবন এবং তা বাজারজাত করার ফলে সবজি চাষে সাফল্য ও বৈচিত্র্য এসেছে। দেশে বর্তমানে ৬০ ধরনের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে, যার সঙ্গে জড়িত ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার।
আলুতে ষষ্ঠ
আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ষষ্ঠ। স্বাধীনতার এক বছর আগে আলু উৎপাদন হয়েছিল ৯ লাখ টন। ৫০ বছরে আলু উৎপাদন ১১ গুণ বেড়েছে। এফএওর হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরে আলু উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ২ লাখ টন। ৯ কোটি ১৪ লাখ টন নিয়ে বিশ্বে প্রথম এখন চীন, আর ৪ কোটি ৯৭ লাখ টন নিয়ে দ্বিতীয় হচ্ছে ভারত।
কাঁঠালে দ্বিতীয়
বিশ্বে বছরে ৩৭ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়। এ ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে। বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ ১০ লাখ টন। বিশ্বে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ টন কাঁঠাল হয় ভারতে। তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড।
আমে অষ্টম
বাংলাদেশ এখন বিশ্বে আম উৎপাদনে অষ্টম। বছরে উৎপাদন হয় ২৪ লাখ টন। ১০ বছর আগে ১২ লাখ ৫৫ হাজার টন নিয়ে অবস্থান ছিল দশম। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানেও উঠেছিল। আম উৎপাদনে সবার ওপরে ভারত। তাদের উৎপাদনের পরিমাণ দেড় কোটি টন। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চীন।
এখন সারা দেশেই আম চাষ হচ্ছে। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে একসময় হিমসাগর, গোপালভোগ, ল্যাংড়া ও ফজলি আমের চাষ বেশি হতো। বর্তমানে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় ব্যাপকভাবে আম্রপালি আমের চাষ হচ্ছে।
পেয়ারায় অষ্টম
১০ লাখ ৪৭ হাজার টন পেয়ারা উৎপাদন করে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম স্থানে। ১ কোটি ৭৬ লাখ টন নিয়ে ভারত প্রথম এবং ৪৪ লাখ টন উৎপাদন করে চীন দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। একসময় শুধু দেশি পেয়ারার চাষ হলেও বিপ্লবটা ঘটিয়েছে থাই জাতের ও কাজি পেয়ারা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে উদ্ভাবিত হয়েছে ১০ প্রজাতির পেয়ারা। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতেই মূলত পেয়ারার চাষ হয়।
একসময়ের ‘সোনালি আঁশ’ খ্যাত পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। উৎপাদনের পরিমাণ ১৩ লাখ ৩৫ হাজার টন, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৪২ শতাংশ। প্রায় ২০ লাখ টন উৎপাদন করে প্রথম ভারত। ভারতে হয় বিশ্বের ৫৫ শতাংশ উৎপাদন। ৪৫ হাজার টন নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে চীন।
তবে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম বাংলাদেশ। পাট দিয়ে ২৮৫ ধরনের পণ্য তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করা হয়।
ছাগলের দুধে দ্বিতীয়
২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেশেই গবাদিপশুর লালনপালন বাড়তে থাকে। গরু ও ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ।
গরু-ছাগলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বৈশ্বিক অবস্থানে বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছে। এফএওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাগলের সংখ্যা, মাংস ও দুধ উৎপাদনের দিক থেকে বৈশ্বিক সূচকে ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। আর ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। ছাগল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দুই দেশ হচ্ছে ভারত ও চীন।
মিঠাপানির মাছে তৃতীয়
মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। নদ-নদীর খারাপ অবস্থা সত্ত্বেও এফএওর মতে, দেশে মিঠাপানির মাছ উৎপাদন হয় বিশ্বের মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশ। ১৬ শতাংশ নিয়ে প্রথম চীন, ১৪ শতাংশ নিয়ে ভারত দ্বিতীয়।
এফএও বলেছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন। গত ১০ বছরে মাছের উৎপাদন ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। আর মাছ রপ্তানি বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি।
আউটসোর্সিংয়ে দ্বিতীয়
শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা ফ্রিল্যান্স বা আউটসোর্সিংকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন এখন। ঘরে বসে অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের চুক্তি করে সেই কাজ শেষ করে অনলাইনের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়াই হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ছয় লাখ, যা শতকরা হারে বিশ্বের প্রায় ২৭ শতাংশ। বদৌলতে বাংলাদেশ এ খাতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যায় প্রথম হচ্ছে ভারত।