স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বড় একটি নিয়োগে বড় অঙ্কের ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ করেছেন নিয়োগ কমিটিরই দুজন সদস্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়ে তাঁরা দাবি করেছেন, এই নিয়োগে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রার্থীদের একটি অংশের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে।
লিখিত পরীক্ষায় অনিয়মের সন্দেহ হয় মৌখিক পরীক্ষা নিতে গিয়ে। নিয়োগ কমিটির সদস্যরা বলছেন, লিখিত পরীক্ষায় যেসব প্রার্থী ৮০ নম্বরের মধ্যে ৬০ থেকে ৭৯ পেয়েছেন, তাঁরা মৌখিক পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। বরং ভালো করেন লিখিত পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া প্রার্থীরা।
মৌখিক পরীক্ষায় পাস করিয়ে দিতে নিয়োগ বোর্ডের এক সদস্যকে ঘুষ ও পদোন্নতির প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন আরেক মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে দেওয়া চিঠিতে নিয়োগ কমিটির এক সদস্য অভিযোগ করেন, তাঁকে নগদ এক কোটি টাকা এবং পরে আরও টাকা ও পদোন্নতি দেওয়ার লোভ দেখানো হয়।
করোনাকালে সরকারি হাসপাতালে কারিগরি জনবল ঘাটতি মেটাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিল। এ জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় গত বছরের ২৯ জুন। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষায় ২ হাজার ৫২১ জন উত্তীর্ণ হন, যা মোট পরীক্ষার্থীর ৫ শতাংশের মতো। তবে যাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাঁদের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ খুব ভালো নম্বর পান, যা থেকেই সন্দেহ তৈরি হয়। পরে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয় খুব কড়াকড়িভাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ও নিয়োগ কমিটির প্রধান শেখ মো. হাসান ইমাম বলেন, ‘কমিটির সদস্যরা যেসব অভিযোগ করেছেন, তা আমি স্বাস্থ্যসেবা সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানিয়েছি। আমার কাছে এর সকল প্রমাণ আছে।’ তিনি বলেন, ‘৮০ নম্বরের মধ্যে যখন একাধিক পরীক্ষার্থী ৭৯ পায়, তখন সেটা ভাবনার বিষয়।’
‘শুক্রবারে এক কোটি টাকা দেব’
অনিয়মের অভিযোগে নিয়োগ কমিটি থেকে যে দুজন সদস্যকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাঁদের একজন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) আ ফ ম আখতার হোসেন। তাঁর জায়গায় গত ২৯ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ দেওয়া হয় ডা. মো. আবুল হাশেম শেখকে। তিনি এর আগে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। তাঁকে এই নিয়োগসংক্রান্ত কমিটিতে সদস্যসচিব করা হয়।
আখতার হোসেন বলেন, তাঁকে কেন সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা তাঁর জানা নেই।
অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) পদে নতুন নিয়োগ পাওয়া ডা. আবুল হাশেম গত ৮ মার্চ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে একটি চিঠি দিয়ে তাঁকে ঘুষের প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তোলেন। ওই সময় স্বাস্থ্যসচিবের দায়িত্বে ছিলেন আবদুল মান্নান। চিঠিতে ডা. হাশেম লিখেছেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (পরিকল্পনা অধিশাখা) শ্রীনিবাস দেবনাথ গত ১ মার্চ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। তখনই তিনি ঘুষের প্রস্তাব দেন।
ডা. হাশেম আরও লেখেন, ‘তিনি (শ্রীনিবাস) বললেন শুক্রবারে আপনাকে এক কোটি টাকা দেব, কোথায় দেখা করব? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী জন্য আমাকে এত টাকা দেবেন? তিনি জানালেন, আমরা যে তালিকা দেব, তাঁদেরকে ভাইভা বোর্ডে পাস করিয়ে দিতে হবে। তাঁরা লিখিত পরীক্ষায় ভালো করেছেন।’
চিঠিতে ডা. হাশেম স্বাস্থ্যসেবা সচিবকে বলেন, ‘আমি শ্রীনিবাস দেবনাথকে জানালাম, ঘুষের বিনিময়ে কোনো কাজ করতে অপারগ। …তিনি জানালেন, এক কোটি টাকা শেষ নয়, নিয়োগের পরে আরও পাবেন, চিন্তা করে দেখুন।’
ডা. হাশেমের চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, শ্রীনিবাস দেবনাথ অনেকের সঙ্গে জড়িত হয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য পরিচালনা করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুজন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত। তাঁরা হলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) ডা. আ ফ ম আখতার হোসেন। অন্যজন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মোহাম্মদ সোহেল। ডা. হাশেমের ভাষ্যমতে, সোহেল একজন নৈশপ্রহরী ছিলেন, যিনি বিধিবহির্ভূতভাবে এমএলএসএস পদে পদোন্নতি পান।
চিঠিতে ডা. হাশেম নিয়োগ-বাণিজ্যের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করার অনুরোধ জানান স্বাস্থ্যসেবা সচিবকে। চিঠি দেওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এই নিয়োগে বড় বাণিজ্য হয়েছে। তাই অভিযোগ লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। স্বাস্থ্যসচিবকে (সাবেক) আমি মৌখিকভাবে বলেছি। তাঁরা আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন।’
‘দুই-চার বছরেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যাইনি’
ঘুষের প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে উপসচিব শ্রীনিবাস দেবনাথের কাছে জানতে চাইলে তিনি গতকাল রোববার দুপুরে মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমি দুই-চার বছরেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যাইনি।’
অবশ্য শ্রীনিবাস জানান, তিনি আরিফুরকে চেনেন। তাঁরা দুজনেই ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর এই ‘ছোট ভাই’ আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এপিএস ছিলেন।
উল্লেখ্য, আরিফুর রহমান সেখ নামের একজন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ছিলেন। নানা অনিয়মের অভিযোগে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
আরিফুর রহমান সেখ বর্তমানে পরিকল্পনা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন। ডা. হাশেমের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি কাছে দাবি করেন, এ ধরনের কথা কাউকে তিনি বলেননি।
সূত্র : প্রথম আলো