শেরপুরঃ শেরপুরের বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক ও ছড়াকার এবং গাঙচিল সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফ আলী চারু’র লেখা ‘নির্বাক জননী’ উপন্যাসটি এই করোনা কালীন লক ডাউনের সুবাদে পড়ার সুযোগ হয়েছে। কোন বইয়ের আলোচনা করার দু:সাহস আমার নেই। তবে বইটি সম্পর্কে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা বুঝতে বা উপলব্ধি করতে পেয়েছি সেটা জানাবো। নির্বাক জননী মূলত আমাদের বাংলা মায়ের বা জন্মভূমির অভাগা ও যুগ যুগ ধারে নিপিরিত-নির্যাতিত হওয়া বাঙালীদের নানান কষ্টের কথা সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে হয়েছে। এসব কষ্ট কথা আমাদের প্রিয় জন্মভূমি নির্বাক হয়ে শুধু দেখেছে। তারই প্রতিচ্ছবি ব্যক্ত করা হয়েছে বইটিতে। তবে এখানে একজন পুত্র অজ্ঞাত বসতে থাকায় তাকে কাছে পাওয়ার জন্য একজন মায়ের আকুতিও ফুটে উঠেছে চমৎকার ভাবে। ভাগ্যক্রমে কাছে পেয়েও না চিনতে পারাটাি ছিলো সেই মায়ের দুর্ভাগ্য।
মূলত উপন্যাসটি এদেশে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে বঙ্গভঙ্গ, পূর্ব বঙ্গ, পূর্ব পাকিস্থান, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা এবং মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে সর্বশেষ স্বাধিন বাংলাদেশ অর্জনে নানা চড়াই-উৎরাইয়ের কষ্ট কথা, নিপিড়ীত বাঙালীর রক্ত দেয়া, ক্ষুধার সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে নারী ছেড়া ধন পুত্রহারা ইত্যাদি ফুটিয়ে তুলেছে চমৎকার ভাবে। বইটি শুধু একটি উপন্যাসই নয়, আমার কাছে মনে হয়েছে বাঙালীদের একটি ইতিহাসও স্থান পেয়েছে এতে।
বইটিতে সম্ভবত ভারত বর্ষের বঙ্গবঙ্গের ঠিক আগ মুহুর্তের একটি বাস্তব ঘটনা নিয়ে রচনা করা হয়েছে। এতে সেই সময়ে চরম দুর্ভিক্ষ চলাকালে তৎকালীন ভারতীয় বঙ্গ প্রদেশের শেরপুর এলাকায় দুইটি পরিবার অভাবের তাড়নায় গ্রাম ছেড়ে কাজ এবং দু’বেলা পেট পুরে খাওয়ার জন্য তৎকালের বঙ্গের আসাম অঞ্চলে প্রত্যাবর্তন করেন। এসময় দু’টি পরিবারের এজনের দুই বছর বয়সের শিশু পুত্র মাহমুদ চরম অসুস্থ থাকায় তার মা-বাবা অনেক বাঁধা সত্বেও তাকে তার দাদা-দাদীর কাছে রেখে আসাম পাড়ি জমায় শুধুমাত্র পেটের দায়ে। সেই ১৯৪৭ সাল বা চল্লিশ দশকের শুরু থেকে ১৯৭১ সাল এবং তারও কিছু পর পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর পর্যন্ত বঙ্গের এ প্রান্তের ছেলে মাহমুদকে কাছে পেতে মা-বাবা এবং মাহমুদের নানান চড়াই উৎরায় ও আকুতির ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ঘটেছে নানান নাটকীয়তা ও হৃদয় বিদারক কষ্ট কথা। ক্ষুধার সাথে যুদ্ধ করতে যেয়ে মাহমুদের মা-বাবা তাকে তৎকালীন বঙ্গদেশের শেরপুর অঞ্চলে ফেলে রেখে আসাম অঞ্চলে চলে যায়। আসাম গিয়ে তারা তাদের ভাগ্য বদলাতে চলে যায় দীর্ঘ সময়। এরমধ্যে বঙ্গভঙ্গ হয়ে আসাম হয়ে যায় ভারতের একটি প্রদেশ আর শেরপুর অঞ্চল পড়ে যায় পূর্ববঙ্গে। ভাগ হয়ে যায় দুই দেশে। পূর্ব বঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্থান এবং সর্ব শেষ স্বাধিন বাংলাদেশ। আসামেও এদেশের মতো নানা আন্দোলন-দাঙ্গা, বাঙালি খেদাও আন্দোলনের মধ্যে মহমুদের মা-বাবাকে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। সেখানেও হয়েছে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন। বাংলাদেশে ৫২ সালে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও সেখানেও (আসামে) ১৯৬১ সালে রাজ্য ভাষা বাংলা ভাষার জন্য প্রাণও দিয়েছে অনেক বাঙালী। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত রাজ্য ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এসব ইতিহাস উঠে এসেছে বইটিতে।
দীর্ঘ এ সময়ের স্রোতে এক সময় মাহমুদ বড় হয়ে তার মা-বাবাকে দেখার আকুতিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে স্মরনার্থী শিবির খোলার সুযোগে মাহমুদ আসাম চলে যায় তার মা-বাবাকে খুঁজতে। দেশ স্বাধিন হয় এক সময় ঘুরতে ঘুরতে আসামে মাহমুদ পাগল বেশে তার জন্মধারিনী মায়ের সার্নিধ্য পেয়েও মা বলে ডাকতে পারেনি এবং তার মাও ছেলেকে কাছে পেয়েও বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেনি। এসব নানা আবেগ ও নাটকীয়তার মধ্যদিয়ে জন্মভূমি এবং জন্মদাতা মা নির্বক হয়ে দেখা ও ভাবা ছাড়া কিছুই করার থাকে না।
গল্পে শত কষ্ট, অভাব, দাঙ্গা, আন্দোলনের পাশপাশি মাহমুদের স্ত্রী ঝর্ণার সাথে বিয়ের আগের প্রণয়ের ঘটনা একটু রোমান্স আনার চেষ্টা করেছে লেখক। তবে বইটির ১৫টি অনুচ্ছেদের মধ্যে সপ্তম অনুচ্ছেদ থেকে যেভাবে নাটকীয়তা ও মূল কাহিনীর দিকে পাঠককে টেনে নিয়েছে সপ্তমের আগের অনুচ্ছেদগুলোতে টানতে পারেনি। লেখক এসময়টাতে সমকালিন ঘটনাকে একটু বেশি হাইলাইট করতে গিয়ে গল্পের মূল কাহিনী থেকে কিটুটা ঝিমিয়ে বা দূরে সরে গিয়েছিল। সমকালিন ঘটনার বর্ণনা ঠিক ছিলো তবে একটু বেশী বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া অভাব আর দু:খ-কষ্টের কথা কিছু কিছু জায়গায় একাধিকবার বলা হওয়ায় একটু ছন্দপতন হয়েছে গল্পে। বেশ কিছু শব্দ আঞ্চলি ভাষায় হওয়ায় সে শব্দগুলো পাঠকতে বোঝাতে বইয়ের শেষে পদটিকা দেওয়া হলে আরো ভালো হতো।
সব মিলিয়ে নির্বাক জননী স্বার্থক হয়েছে শুধু মায়ের টানই নয় জন্মভূমি, মাতৃভাষা, স্বাধিকার, জমিদারী নির্যাতন, বৃট্রিশ শাসন, ওপারে ধর্মগত বিরোধ থাকলেও এপারে হিন্দু-মুসলিম ছিলো সহাবস্থানে এসব চিত্র বেশ সুন্দর ও সাবলিল ভাবে ফুটিয়ে তোলায় বইটি আগামী প্রজন্মের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কবি।