দুই বছর আগে ক্যাসিনোকাণ্ডে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে দেশের ২২ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই তালিকার অন্যতম ছিলেন পটিয়ার সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী।
সে সময় দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁরা যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারেন সে বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ করা যাচ্ছে। একইসঙ্গে ওই সময় জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে আরো কয়েকজনের সঙ্গে সামশুল হকের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) অনুরোধ জানায় দুদক।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে হুইপসহ অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার কথা জানিয়েছিল দুদক। দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দুদকের পাঠানো ওই চিঠির বিষয়ে সংস্থাটির সাবেক সচিব দিলওয়ার বখত তখন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রাথমিক অনুসন্ধানে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ’
সামশুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করতে সে সময় সামশুল হক চৌধুরীর পিএ নুর উর রশীদ চৌধুরীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
ওই সময় ক্যাসিনোতে অভিযান চালানোর বিপক্ষে অবস্থান নেন সামশুল হক চৌধুরী। তিনি বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রামে ১২টি ক্লাব আছে। ক্লাবগুলো প্রিমিয়ার লীগ খেলে। ওদের তো ধ্বংস করা যাবে না। ওদের খেলাধুলা বন্ধ করা যাবে না। প্রশাসন কি খেলোয়াড়দের পাঁচ টাকা বেতন দেয়? ওরা কিভাবে খেলে, টাকা কোন জায়গা থেকে আসে, সরকার কি ওদের টাকা দেয়? দেয় না। এই ক্লাবগুলো তো পরিচালনা করতে হবে। ’ তাঁর ওই বক্তব্য তখন ব্যাপক সমালোচিত হয়।
হুইপের বিরুদ্ধে তদন্তের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে সামশুল হক চৌধুরীসহ আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এখনো তদন্ত পর্যায়েই রয়েছে। ’
জানা যায়, যুবদল ও জাতীয় পার্টির রাজনীতি থেকে ডিগবাজি দিয়ে আওয়ামী লীগে এসে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ‘মধুর হাঁড়ি’র সন্ধান পেয়ে যান সামশুল হক চৌধুরী। তাঁর সম্পদ বাড়ছে অস্বাভাবিক গতিতে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার প্রমাণ পাওয়া যায় নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামার সম্পদ বিবরণীতেই। জাতীয় সংসদ সদস্য পদে থাকার সময়েই ‘রকেট গতিতে’ বেড়েছে তাঁর ব্যাবসায়িক প্রবৃদ্ধি। হলফনামায় উল্লেখ করা সম্পদ বিবরণীর বাইরেও তিনি প্রচুর সম্পদের মালিক বলে জানিয়েছেন তাঁরই ঘনিষ্ঠজনরা। নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা এবং রাজকীয় জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই হুইপ সম্পদ বিবরণীতে আসবাবের মূল্য প্রদর্শন করেছেন ‘শায়েস্তা খাঁ’র আমলের। আর রিয়াজুদ্দিন বাজারের মতো একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় ৯০০ বর্গফুটবিশিষ্ট চারতলা ভবন তথা তিন হাজার ৬০০ বর্গফুট ভবনের মূল্য উল্লেখ করেছেন দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা। প্রতি বর্গফুটের দাম পড়ে ৭৭ দশমিক ৭৮ টাকা! এমন ‘শায়েস্তা খাঁ’র আমলের সম্পদের মূল্য দেখানো হয়েছে মূলত নিজের সম্পদমূল্য কম প্রদর্শনের জন্যই।
সামশুল হক চৌধুরী প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ২০০৮ সালে। ওই নির্বাচনে প্রচার ব্যয় চালানোর মতো আর্থিক সংগতি ছিল না তাঁর। এ কারণে শ্যালক ও ভায়রার কাছ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা এবং নিজের মাত্র ৫০ হাজার টাকা নিয়ে সংসদ নির্বাচনের মাঠে নেমেছিলেন। ওই সময় তিনি এতই দরিদ্র ছিলেন যে তাঁর হাতে নগদ টাকা ছিল মাত্র এক হাজার ৩৬৯ টাকা। আর তাঁর স্ত্রীর কোনো সম্পদই ছিল না। কিন্তু ২০১৩ সালে দ্বিতীয় দফা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর মাত্র ১০ বছরে সামশুল হক চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রীর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে অন্তত এক হাজার ৫৪৬ শতাংশ। তৃতীয় দফা সংসদ নির্বাচনের আগে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় উল্লেখিত সম্পদের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে হলফনামা দাখিল করে তিনি নিজের সম্পদের বিবরণ দিয়েছেন। এই তিন নির্বাচনের সময় হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তাঁর আয়ের সঙ্গে সংসদ সদস্য হিসেবে প্রাপ্য সম্মানীর টাকাও যোগ হয়েছে। ২০০৮ সালে সামশুলের স্ত্রী ছিলেন নিঃস্ব। আর সংসদ সদস্যের স্ত্রী হওয়ার ‘জাদুবলে’ তিনিও অঢেল সম্পদের মালিক। তাঁর নামেও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ যোগ হয়েছে।
সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৮ সালে সামশুল হক চৌধুরী ২১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৬৯ টাকার সম্পদের মালিক ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর স্ত্রীর নামে কিছু ছিল না। পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামায় তাঁর সম্পদের পরিমাণ বাড়ে ৫৩০ শতাংশ। এই সময়ই তাঁর স্ত্রী লাখপতি হয়ে ওঠেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ব্যয় করেছিলেন দানের টাকায়। আর ২০১৪ সালে নিজেই ব্যয় করেন ২০ লাখ টাকা। এই সময় সামশুল হকের ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ৪০ লাখ ১২ হাজার ৩৬৬ টাকা। ২০০৮ সালে তাঁর একটি প্রাইভেট কার ছিল।
২০১৪ সালে সেটি পরিবর্তন করে ৬১ লাখ ৫০ হাজার টাকা দামের গাড়ি ব্যবহার করেন তিনি। এই সময়ে তিনি পটিয়ার রশিদাবাদ গ্রামে ‘রাজপ্রাসাদ’ নির্মাণ করেন। কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই বাড়ির নির্মাণ ব্যয় হলফনামায় দেখানো হয়েছে মাত্র ৪৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। এই সময়ে তাঁর স্ত্রীর নামেও স্থাবর-অবস্থাবর সম্পদ বেড়েছে।
সম্পদ বৃদ্ধির আস্ফাালন হয়েছে ২০১৮ সালের হলফনামায়, যা ২০০৮ সালের সঙ্গে তুলনা করলে ১০ বছরের ব্যবধানে বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ৫৪৬ শতাংশ। এই সময়ে এই দম্পতির ভূ-সম্পত্তি বেড়েছে ৩২ লাখ টাকার। অস্থাবর সম্পদের সঙ্গে ডলার যুক্ত হয় প্রায় ২৭ লাখ টাকার। ব্যাংকে জমা ছিল ৯২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ৬৩৮ টাকা। স্বামী-স্ত্রী দুজনের বন্ড বা ঋণপত্র সম্পদ যুক্ত হয়ে পাঁচ লাখ টাকার সঙ্গে ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও অলংকারের পরিমাণও বাড়ে।
২০০৮ সালে সামশুল হকের আসবাব ছিল মাত্র ২০ হাজার টাকা মূল্যের। ২০১৮ সালে এসে স্ত্রীর আসবাব বেড়েছে ৮০ হাজার টাকার। এই দম্পতির মাত্র এক লাখ টাকার আসবাব আছে হলফনামার তথ্য অনুযায়ী। অথচ তাঁদের গ্রামের বাড়ির রাজপ্রাসাদ, চট্টগ্রাম মহানগরীর হালিশহর এলাকার বাসার আসবাব এবং ঢাকার গুলশানের বাসার আসবাব চোখ-ধাঁধানো এবং রাজকীয়। অত্যন্ত দামি আসবাব দিয়ে তিন জায়গার বাড়ি-বাসা সুসজ্জিত হলেও এসবের মূল্য নির্ধারণে অবিশ্বাস্যভাবে ‘শায়েস্তা খাঁ’র আমলকেই বেছে নিয়েছেন। এই সময়ে এই দম্পতির স্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে এক কোটি ২১ লাখ ৭৮ হাজার ১৭০ টাকার।
দুদকের কাছে অভিযোগ রয়েছে, হলফনামায় প্রদর্শিত সম্পদের বাইরেও নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন হুইপ দম্পতি। বিদেশে পাচার করেছেন বিপুল অর্থ। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই দুই বছর আগে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিতে পুলিশের বিশেষ শাখায় (ইমিগ্রেশন) চিঠি পাঠিয়েছিল দুদক। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সামশুল হক চৌধুরীকে ফোন করলেও তাঁর কোনো সাড়া মেলেনি।
সূত্র : বাংলা নিউজ