(ফুলছড়ি) গাইবান্ধা: ঢাকার রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে নিহত পরিবারের ৬৪ সন্তান বেড়ে উঠছে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়ায় ‘অরকা হোম্সে’। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৮ জনের বেশি শ্রমিক প্রাণ হারান। দুর্ঘটনায় হাজারো শ্রমিক আহত হন। আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেন অনেকে। এসব নিহত, আহত ও পঙ্গুত্ববরণকারী পরিবারের অসহায় সন্তানরা অরকা হোম্সে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়ে লেখাপড়া, খেলাধুলা, বিনোদন ও মাতৃস্নেহে বেড়ে উঠছে।
উপজেলার কঞ্চিপাড়ায় ‘অরকা হোমস’ নামের প্রতিষ্ঠানে বেড়ে উঠছে আল-আমিন, ওলি হোসেন, ফাতেমা আক্তার মিম, সোনালী আক্তার বিথী, জিয়াদ হোসেনসহ ৬৪ জন ছেলে/মেয়ে। ওরা সবাই সাভারের রানা প্লাজা ধসে হতাহত নারী পোশাক কর্মীদের সন্তান। এদের কেউ মাকে হারিয়েছে। কারো মা থাকলেও বাবা নেই। আবার আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেছে কারও মা কিংবা বাবা।
এইসব ট্র্যাজেডি শিকার পরিবারের সন্তানগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের সংগঠন ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেট অ্যাসোসিয়েশন (অরকা)। দুস্থ ও এতিম শিশুদের জন্য ২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘অরকা হোম্স’ নামে একটি আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলেছে অরকা। তাদের সহায়তা করছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্ততকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। তিনতলা ভবন বিশিষ্ট অরকা হোমসে লাইব্রেরি ও বিনোদনের ব্যবস্থাসহ রয়েছে বিশাল খেলার মাঠ। প্রতিষ্ঠানটিতে রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে নিহত ও আহতদের পরিবারের ৬৪ ছেলে/মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছে অরকা হোমস। এদের মধ্যে ৩৪ জন ছেলে ও ৩৪ জন মেয়ে রয়েছে।
৬৪ জন সন্তানদের মধ্যে গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন উপজেলার ১০, পাবনার ৭, জামালপুরের ১, রংপুরের ৮, সিরাজগঞ্জের ২, দিনাজপুরের ২, সাভারে ১৯ জনসহ দেশের বিভন্ন স্থানের ১৫ জন ছেলে/মেয়ে প্রতিষ্ঠানটির যাবতীয় সুবিধা ভোগ করে আসছে। রানা প্লাজায় নিহত নার্গিস বেগমের ছেলে আল-আমিন মিয়া। সাদুল্লাপুর উপজেলার কিশামত শেরপুর গ্রামের তোজাম্মেল হক তুহিন এর ছেলে। অরকা হোমে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। সে জানায়, মা মারা যাবার পর এখানেই আমার ঠাঁই হয়েছে। সরকারিভাবে ৯ লাখ টাকা পেয়েছি। পিতা তুহিন মিয়া পেয়েছেন ৭ লাখ। বাবার টাকা বিভিন্ন কাজে বিনিয়োগ করে। আমার টাকা এখনো ব্যাংক থেকে উঠানো হয়নি। অরকা হোম এর সহায়তা লেখাপড়া শিখে প্রকৌশলী হব।’
সাভারের ফাতেমা আক্তার মিম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানায়, ‘ওই ঘটনায় মা বুকে আঘাত পেয়ে ভীষণভাবে আহত হন। সেই আঘাত এখন ক্যানসারে পরিণত হয়েছে। দিনমজুর শ্রমিক বাবাও অসুস্থ। কাজ হারিয়ে আমাদের লালন-পালনে অক্ষম তিনি। অরকা হোমস আমার থাকা-খাওয়া ও লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছে। আমার ছোটবোন সোনালী আক্তার বীথি আমার সঙ্গে এখানে থাকে। সে ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ে। আমি দশম শ্রেণিতে পড়ছি। আমরা ভালো আছি।’ তাদের মতো প্রায় সবাই ভালো থাকার কথা জানায়। প্রচলিত দুস্থ আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। এখানে থাকা শিশু-কিশোরদের পোশাক-পরিচ্ছদ এবং চলাবলায়ও সুরুচির ছাপ স্পষ্ট। এখানে থাকা শিশু-কিশোরের সবাই পড়াশোনা করছে পাশের মুসলিম একাডেমিতে। এসব শিশু-কিশোরদের দেখভালের জন্য রয়েছেন তত্তাবধায়ক। তাদের জন্য রাখা হয়েছে গৃহশিক্ষক। রয়েছেন শরীরচর্চার শিক্ষকও। ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থাও রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা সব সময়ই স্নেহ-মমতা দিয়ে ওদের মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখার চেষ্টায় থাকেন।
অরকা হোমস কেয়ারটেকার নুর জাহান বেগম বলেন, রানা প্লাজার এসব শিশুদেরকে মাতৃস্নেহে আমি লালন-পালন করছি। তারা একটু ব্যথা পেলে আমারও কষ্ট লাগে। তাদের পড়াশুনা, খেলাধুলা এমনকি গোসল করিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে ওদের যাবতীয় কাজকর্ম করে থাকি। নিজের বাচ্চার মতো করে মানুষ করছে নুর জাহান। আর এসব স্বজন হারানো শিশুরাও মাঝে খুজে নিচ্ছে তাদের মা-কে।
ফুলছড়ি অরকা হোমসের পরিচালক মো. জাহিদুল হক বলেন, ‘দেশ-বিদেশে থাকা অরকার সদস্যদের আর্থিক সহায়তার ভিত্তিতেই মূলত আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যয় মেটানো হয়। এ ছাড়া রফতানিমুখী তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ হোমসের শিশুদের জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়। এখানে বসবাসকারী শিশুদের লেখাপড়া শেষ করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। শিশুরা যেন বাবা-মায়ের মতো স্নেহ পায় সে জন্য খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এখানকার শিশুরা যেদিন সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে, সেদিনই তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে।’