শেরপুরঃ
এক বছর আগে অজুফা বেগম দেনমোহর ও ভরণপোষণ আদায়ের জন্য জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে গিয়ে আবেদন করেন। শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার অজুফা বেগম স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে এক বছর আগে বাবার আশ্রয়ে ফিরে আসেন। অজুফার মেয়ের বয়স তখন ছয় বছর । যৌতুক না পেয়ে স্বামী মোরশেদ পরে তাঁকে তালাক দেন। এ অবস্থায় এক আত্মীয়ের কাছো অজুফা জানতে পারেন জেলা লিগ্যাল এইড শেরপুর অফিসের কথা। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তিনি সেখানে গিয়ে আইনগত সাহায্যের আবেদন করেন। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সহকারী জজ) অজুফার পক্ষে মামলা লড়তে ওই সময়েই প্যানেল আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পারিবারিক এই মামলায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অজুফার পক্ষে রায় হওয়ার পর অজুফার স্বামী তার স্ত্রীর সমস্ত পাওনা জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মধ্যস্থতায় পরিশোধ করেন। এ বিষয়ে অজুফা বেগম বলেন, ‘মামলা চালাতে আমার একটি পয়সাও খরচ হয়নি। দেনমোহরের অর্থ বুঝে পেয়েছি। জেলা লিগ্যাল এইড শেরপুর অফিস আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।’অজুফার মতো এমন আর্থিক অসচ্ছল ভুক্তভোগীদের বিনা মূল্যে আইনি সেবা দিয়ে যাচ্ছে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার অন্তর্ভুক্ত জেলা লিগ্যাল এইড অফিস ।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, করোনার অতিমারীর কালে বিগত এক বছরে অর্থাৎ ২৮ এপ্রিল ২০২০ থেকে ২৮ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত সরাসরি মামলার জন্য মোট আবেদন পড়েছে ৩৪৫ টি, মোট মামলা নিষ্পত্তি ৬৫ টি, বিকল্প পদ্ধতিতে সফল নিষ্পত্তি ২৮৩ টি, নথিজাত আছে ৮৩ টি, অপেক্ষামান ১০৩ টি, পরামর্শ প্রদান করা হয় ৭৪২ জনকে এবং এডিআর এর ফলে বিচারাধীন বা চলমান মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ২৪২ টি । এডিআর এর মাধ্যমে মোট ২ কাটি ৫০ লক্ষ ৪৭ হাজার ৬৫০ টাকা আদায় করে পক্ষগণের মধ্যে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। যা বিগত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ ব্যক্তি সরকারি আইনি সহায়তা পেয়েছেন।জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সহকারী জজ) মোঃ জুলফিকার হোসাইন রনি জানান, মানুষ এখন নিজের অধিকার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সম্মানিত সভাপতি মাননীয় জেলা ও দায়রা জজ মহোদয়ের সার্বিক দিকনির্দেশনায়, শেরপুর আদালতের প্রত্যেক বিচারকের সক্রিয় ভূমিকা, জেলা প্রশাসন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা আইনজীবী সমিতিসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত সহযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে জেলা লিগ্যাল এইড অফিস শেরপুরের কার্যক্রম। বিনামূল্যে আইনি সেবার পাশাপাশি বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআর কার্যক্রম বিচারপ্রার্থী জনগনের মাঝে দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। সূত্র মতে, গত এক বছরে প্রায় দুই হাজারেরও বেশি মানুষকে আইনি সহায়তা দেওয়া হয়েছে এর মধ্যে সিংহ ভাগই নারী। সেবা প্রক্রিয়া সহজীকরণ, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে লিগ্যাল এইড কমিটিগুলো সক্রিয় করা, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও প্যানেল আইনজীবীদের সাথে নিয়মিত সমন্বয়ের মাধ্যমে এই মহৎ সেবা কার্যক্রমের ব্যাপ্তি বেড়েছে। উন্নত বিশ্বে এখন আদালতে মামলা করার চেয়ে আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এই ধারণা সামনে রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আইনমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগে এডিআর কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, ২০০০ সালে আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়সম্বলহীন ও নানাবিধ আর্থসামাজিক কারণে বিচার পেতে অসমর্থ জনগণকে সরকারি খরচে আইনি সহায়তা দিতে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ করা হয়। ওই আইন অনুসারে ২০০১ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা গঠন করা হয়। তবে জনবল ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাবসহ নানা কারণে সূচনাকাল থেকে ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত সংস্থাটির কার্যক্রম ছিল স্থবির। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার জন্য আলাদা কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংস্থাটি ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি প্রতিটি জেলা আদালতে সংস্থার কার্যালয় স্থাপন ও স্থানীয় কমিটি গঠন করা হয়। সে সময় থেকে আইনগত সেবা নেওয়ার হার বাড়তে শুরু করে। এখন দেশের ৬৪ জেলায় স্থায়ী লিগ্যাল এইড কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। প্রতি বছরের ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালিত হচ্ছে। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা জেলা কমিটিগুলোতে যে অনুদান দিত, অনেক ক্ষেত্রেই তা খরচ হতো না। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ওই তহবিলের আওতায় ২০০৯ ও ২০১০ সালে ৬৪টি জেলায় ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ব্যয় হয়েছিল ৬৭ লাখ ৯২ হাজার ৬৮৯ টাকা। পরের বছর ব্যয় হয় ৭৩ লাখ ৯৩ হাজার ৫৯৬ টাকা। সংস্থা সূত্রে জানা যায়, এবার (২০১৯-২০ অর্থবছর) ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া সুবিধাবঞ্চিত কারখানার শ্রমিকদের মজুরি, নিরাপত্তা ও চাকরিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্যও আছে শ্রমিক আইনগত সহায়তা সেল। ২০১৩ থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১৭ হাজার ৩২৪ জন এই আইনি সেবা নেন। অন্যদিকে যোগাযোগ ও আইনগত বিষয়ে পরামশ্যের জন্য ২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল ‘সরকারি আইনি সহায়তায় জাতীয় হেল্পলাইন’–এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়, টোল ফ্রি নম্বরটি হচ্ছে ১৬৪৩০।
মাঠপর্যায়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, স্থানীয় প্রশাসনের সম্পৃক্ততা, সেবা প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং কার্যক্রম তদারকিতে অভ্যন্তরীণ ই-সেবা ব্যবস্থাপনা আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের ব্যাপক সাড়ার ফেলেছে। জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি একেএম মোসাদ্দেক ফেরদৌসী জানান, বর্তমান জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তারা যোগদানের পরে শেরপুর বিচার বিভাগে মানুষের বিচার প্রাপ্তিতে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে।