দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার ও শোষণ মানব সমাজের চিরন্তর চরিত্র। এটি দেশে-দেশে, সমাজে-সমাজে, পরিবারে-পরিবারে বিস্তৃত। দুর্বলের কোনো লিঙ্গ নেই- নারীও হতে পারে, পুরুষও হতে পারে। যেসব দেশ সভ্যতার আলোয় আলোকিত হয়েছে তাদের সমাজে আইনের দৃঢ় বন্ধন, আইনের প্রয়োগ এবং নৈতিকতার উন্নয়নের মাধ্যমে দুর্বলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু আলোকিত বা সভ্য নামাঙ্কিত দেশগুলো সুযোগ পেলেই দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ওপর অর্থনৈতিক শোষণ করে থাকে।
আমরা ৫০ বছর আগে স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন না থাকা এবং রাজনীতিতে ধর্ম, কালো টাকা, পেশি শক্তির যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে রাষ্ট্র ও সমাজে দুর্বলের শারীরিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এখনো পরিপূর্ণ নিশ্চিত হয়নি। জাতির জনককে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ব্যাহত হয়েছে। বাংলাদেশকে দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রাণপণ চেষ্টা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা তার একক প্রচেষ্টায় দেশের যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধনের পাশাপাশি দুর্বলের অর্থনৈতিক, শারীরিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন, কিন্তু এখনো তা পূর্ণতা পায়নি। বরং ধর্মের নামে বারবার তার মহৎ উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।
এ দেশে মুসলমান জনসংখ্যার হার ৯০ শতাংশের ওপরে এবং রাষ্ট্রের চরিত্র ধর্মনিরপেক্ষ। স্বভাবতই রাষ্ট্র ও সমাজে ইসলামের শাশ্বত বাণীর প্রাধান্য রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানও ইসলামের শাশ্বত বাণী ধারণ করে। বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে ইসলামের মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও জনহিতকর মর্মবাণীর কোনো সংঘাত নেই। ইসলাম পৃথিবীতে প্রচলিত অন্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার কখনো খর্ব করে না। বাংলাদেশের সংবিধানও সব ধর্মের মর্যাদা, অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করেছে। ইসলামসহ প্রায় সব ধর্ম সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি মানুষকে সমমর্যাদা প্রদান করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানও একই নীতি ধারণ করে।
কিন্তু শতকের পর শতক ধরে অপেক্ষাকৃত সবলরা অপেক্ষাকৃত দুর্বলের প্রতি অত্যাচার, নির্যাতন, ব্যভিচার, শোষণ চালিয়ে আসছে। আমাদের সমাজে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, আয় করার সক্ষমতার ওপর মানুষের অবস্থান নির্ণয় করা হয়। সেই আয় বৈধ বা অবৈধ যাই হোক।
বাংলাদেশে ঘরে ঘরে নারী নির্যাতন ও অপমান তার আয় করতে না পারার দুর্বলতার কারণে অনেকাংশে নির্ধারিত হয়। ক্রমশ নারী আয় করা শিখছে, ফলে সম্মান এবং মর্যাদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরপরও পুরুষের দৈহিক ও অর্থনৈতিক শক্তির কারণে এখনো নারী ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ, অনিচ্ছাকৃত ও প্রলোভিত দৈহিক মিলন ও শারীরিক নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে অসংখ্য নারীবাদী ও সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক শক্তি উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করছে। ধীরলয়ে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটছে।
কিন্তু একটি সেক্টরের প্রতি আমাদের দৃষ্টি ক্ষীণ এবং তার ভয়াবহতা মারাত্মক। সেটি হলো, শিশু নির্যাতন ও শিশুশ্রম। প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশে প্রকাশ্যে শিশুশ্রম প্রচলিত এবং অতি সঙ্গোপনে শিশু নির্যাতন সংঘটিত হয়ে আসছে। গত এক যুগে দেশের যুগান্তকারী উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ঐতিহাসিক সাফল্যের কারণে শিশুশ্রমের ভয়াবহতা কমে এসেছে। সরকারের পাশাপাশি দারিদ্র্য জনগণ জন্মনিয়ন্ত্রণ ও সন্তানের প্রতি আর একটু আন্তরিক হলে স্বল্প সময়ের মধ্যে শিশুশ্রম শূন্যের কোটায় নেমে আসবে।
কিন্তু শিশু নির্যাতন সম্পর্কে একটি জাতীয় জাগরণ ছাড়া এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। মেয়ে শিশুরা প্রতিনিয়ত তার পরিবারেই নিকট আত্মীয় কর্তৃক যৌন হেনস্তার শিকার হয়। আশার দিক হলো- মেয়েরা প্রতিবাদ করতে শিখছেন, নিজেকে সংহত করার সাহস সঞ্চয় করছেন বিধায় এর ভয়াবহতা কমে আসছে। আমাদের সমাজে সন্তানের মায়েরা স্বীয় পরিবারে মেয়ে ও ছেলে শিশুর মাঝে খাদ্য ও পুষ্টি প্রাপ্তি, সাংসারিক শ্রম এবং নানাবিধ বিষয়ে বিভাজন সৃষ্টি করেন। মূলত নারীর জীবনের বঞ্চনার শুরু হয় তার জন্মদাত্রী মায়ের হাত দিয়ে। মায়েরা এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে ছেলে, মেয়ে উভয় শিশুকে সমদৃষ্টিতে প্রতিপালন করলে মেয়ে শিশুর মানসিক বিকাশ উন্নততর হবে এবং তার মাঝে আত্মরক্ষার মনোবল ও আত্মসম্মানবোধ বৃদ্ধি পাবে। যা ভবিষ্যতে তাকে নির্যাতন থেকে সুরক্ষা দেবে।
ছেলে শিশু নির্যাতন আমরা প্রতিনিয়ত না দেখার ভান করছি। বিশেষ করে আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুর প্রতি মানবিকতার নামে যে নির্মম নির্যাতন চলে আসছে তা নিয়ে সমাজ উদ্বিগ্ন নয়। এখন এ বিষয়ে নজর দেয়া সময়ের দাবি। আমরা সন্তানকে সুশিক্ষা অর্জন করে শিক্ষিত, দক্ষ, জনহিতকর ও নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমের আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমর্পণ করি। এছাড়া বিভিন্ন আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এতিম-অসহায় শিশুর ঠিকানা হয়।
সম্প্রতি একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে পাস ও ইন্টার্ন করা একজন ডাক্তারের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। তিনি আমাকে তথ্য দেন যে, তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেলে বিভিন্ন সময় অনেক অসুস্থ শিশুর চিকিৎসা দিয়েছেন এবং দেখেছেন। তাদের অনেকেই হাসপাতালে আসেন পায়ুপথের নির্মম আঘাতের চিকিৎসা নিতে। শিশুরা জানিয়েছেন যে, তারা শিক্ষক ও সিনিয়র ভাইদের দ্বারা বলাৎকার হয়ে অসুস্থ হয়েছেন। তারা সমকামে রাজি না হলে পড়াশোনার নানাবিধ অজুহাত তুলে প্রতিনিয়ত বেদম প্রহার করা হয়। তিনি শিশু বলাৎকারের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন এবং শিশুর মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে এর পরম নেতিবাচক দিক সম্পর্কে বলেন।
ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে কথা বলার পর আমি বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে চলমান বিভিন্ন আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে খোঁজ নিই। কোথাও ভয়াবহতা পেয়েছি, কোথাও মৃদু সমস্যার সন্ধান পেয়েছি। আমাদের দেশের প্রচলিত আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সম্প্রতি বিকশিত কিছু আবাসিক কোচিং সেন্টার ও প্রি-ক্যাডেট পদ্ধতি ব্যয়ভার শিক্ষার্থীর অভিভাবকের অর্থে নির্বাহ হয়। এগুলো ব্যবসায়িক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাকি সব আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাবলিক মানি দ্বারা পরিচালিত। কোনোটি জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকারি অনুদানে, কোনোটি সরাসরি জনগণ কর্তৃক দানকৃত অর্থে পরিচালিত হয়। রাষ্ট্র ও জনগণ উভয়েই সুনাগরিক গড়ার লক্ষ্যে এই অর্থ দান বা বিনিয়োগ করে থাকেন। প্রাপ্ত বয়স্ক অর্থাৎ ১৮ ঊর্ধ্বদের আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন না হলেও চলবে। কারণ ১৮ হলে শিক্ষার্থীর নিজেকে সুরক্ষার সামর্থ্য অর্জিত হয় এবং মেলামেশার ক্ষেত্রে তার নিজস্ব চিন্তাবোধ গড়ে ওঠে।
শিশুদের শারীরিক নিরাপত্তা চরম উদ্বেগের বিষয়। সেটি ছেলেমেয়ে উভয় লিঙ্গের জন্য। শিশু পিতৃতুল্য শিক্ষক ও সিনিয়রদের দ্বারা ধর্ষণ, বলাৎকার বা যৌন স্পর্শের শিকার হলে তার মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তিনি একজন বিকারগ্রস্ত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠেন। জনগণ বা রাষ্ট্র অর্থ দান করে একটি ভালো পরিবেশে যতটা সম্ভব উন্নত খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণপূর্বক ভালো শিক্ষা গ্রহণের জন্য। প্রাপ্ত অর্থ কতটা শিক্ষার্থীর খাদ্য ও পুষ্টির জন্য ব্যয় হয়, কতটা শিক্ষক ও পরিচালনাকারীরা ভোগ করেন তা প্রশ্নবোধক। যে পদ্ধতির শিক্ষা শিক্ষার্থীরা শিখছেন, তার মান সব সময় খারাপ নয়। অনেক ক্ষেত্রে পাঠ্যসূচিভুক্ত শিক্ষার মান বেশ ভালো। কিন্তু নৈতিক শিক্ষা, মানসিক বিকাশ ইত্যাদির ক্ষেত্রে অনেক আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান ভয়াবহ।
একজন শিশু খাদ্য ও শিক্ষার বিনিময়ে ধর্ষিত হবে, বলাৎকার বা বিকৃত যৌনচারের শিকার হবে, এটি আদিম সমাজে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল, স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে সম্ভব নয়। এই যৌন নির্যাতনকে ‘মানবিক’ যৌন মোড়ক লাগালেও এটি ধর্ম, আইন ও নৈতিকতা চোখে একটি নিকৃষ্টতম অপরাধ। এই অপরাধী সভ্য সমাজের জনপ্রতিনিধি, সরকারি, বেসরকারি কর্মচারী, শিক্ষক বা আলেম লেবাসধারী যে কোনো ব্যক্তিই হোন তার প্রতি কঠোর হওয়া রাষ্ট্র ও প্রত্যেক নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব। ইতোমধ্যে একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে শিশুদের শারীরিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের একটি আবেদন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে পেশ করেছি।
আজকের শিশুরাই আগামীর রাষ্ট্র ও সমাজের পরিচালক। তারাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের একটি সুস্থ পরিবেশে গড়ে ওঠার জন্মগত অধিকার রয়েছে। তাদের শারীরিক, মানসিক, নৈতিক বিকাশের জন্য শান্তিপূর্ণ শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব। প্রত্যেক নাগরিকের শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতন ও সোচ্চার হওয়া নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে ছোটদের স্নেহ করে না, সে আমার উম্মত না।’ তাঁর এই অমর বাণী ধারণ ও প্রতিপালন করা প্রত্যেক মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব এবং আমরা এই দায়িত্ব এড়াতে পারি না। তিনি ছোটদের স্নেহ করতে নির্দেশ করেছেন। আমরা স্নেহ না করে উল্টো ছোটদের নিগ্রহ করছি। এই অপরাধ জালিমের পর্যায়ে পড়ে। এই জালিম কর্মকাণ্ড জেনেও প্রতিবাদ না করা, নিরসনের জন্য উদ্যোগ না নেয়া জালিমকে সমর্থনের নামান্তর। বিষয়টি নিয়ে প্রত্যেক বিবেকবান, ধর্মপ্রাণ, দেশপ্রেমিক নাগরিকের চিন্তা করা উচিত।
আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই- জঙ্গি মাহমুদের এই অমর পঙ্ক্তির প্রতি আমাদের সবার সক্রিয় সমর্থন ও কার্যকর অবদান একটি সুস্থ, সবল, সমৃদ্ধ জাতি গঠনে অবদান রাখবে।
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি : হুইপ, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ; সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।