অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কেনা ১০টি ইঞ্জিনের অর্থ পরিশোধে সুবিধাপ্রাপ্ত রেলের কিছু কর্মকর্তা তৎপর হয়ে উঠেছেন। নিম্নমানের যন্ত্রাংশের ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করা হলে দেশের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হবে। চুক্তিভঙ্গের কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
উলটো এ লকডাউনের মধ্যে ইঞ্জিনগুলোর মূল্য পরিশোধে সুবিধাবাদীরা জোট বেঁধেছেন। অথচ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালকসহ (রোলিং স্টক) অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সাবেক প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নূর আহমদ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। তবে কোম্পানিসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে রোববার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, চুক্তি ভঙ্গের সঙ্গে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করার সঙ্গে জড়িতরা দায় এড়াতে পারেন না। এছাড়া তদন্ত কমিটির সুপারিশ থাকলেও কোম্পানিটির বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
উলটো সংশ্লিষ্টরা তাড়াহুড়ো করে অর্থ পরিশোধ করতে চাচ্ছে। আবার কমিটির সুপারিশও আমলে নেওয়া হচ্ছে না। পিডি পরিবর্তন করা হয়েছে। এ কারণে ধরে নিতে হবে দুর্নীতি রয়েছে। অবৈধ লেনদেন রয়েছে। সুবিধাবাদী কারা, কারা অনিয়ম-দুর্নীতি জায়েজ করতে যাচ্ছে- তাদের চিহ্নিত করতে হবে। আমরা মনে করি না, এমন অনিয়ম-দুর্নীতির বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। তিনি বলেন, অন্য দেশ হলে ইঞ্জিনগুলো কিছুতেই গ্রহণ করত না।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আগামী জুনের মধ্যে এ প্রকল্প শেষ করতে চাচ্ছে বর্তমান পিডিসহ সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য সুবিধাবাদী কর্মকর্তারা একসঙ্গে লড়ছেন। আগের পিডি নূর আহমদকে ইতোমধ্যে বাদ দিয়ে নতুন পিডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
অথচ আগের পিডি যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন তাদের কিছুই হয়নি। বর্তমান পিডি হাসান মনসুর অতি উৎসাহী হয়ে লকডাউনের মধ্যে ২/১টি ইঞ্জিন ট্রায়াল রান করাচ্ছেন। এসব ইঞ্জিন এর আগে বেশ কয়েকবার ট্রায়াল করা হলেও চুক্তিতে থাকা সর্বোচ্চ গতি তোলা যায়নি।
ইঞ্জিনগুলো কিনতে ২০১৮ সালের ১৭ মে হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে চুক্তি হয়। এগুলো কিনতে তিন কোটি ৭৯ লাখ ৬৩ হাজার ৪০০ ডলারের চুক্তি হয়। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম দেওয়া হয়। ইঞ্জিনগুলো দেশে আসার পর ৬৫ শতাংশ ও গুণগত মান যাচাই শেষে বাকি ১০ শতাংশ অর্থ পরিশোধের কথা ছিল। তবে নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহের কারণে চুক্তিমূল্যের ৬৫ শতাংশ অর্থ আটকে দেন আগের পিডি নূর আহমদ। একই সঙ্গে এ অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযাগ করেন। সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে চিঠি দিয়ে ৬৫ শতাংশ অর্থ না দিতে অনুরোধ করা হয়।
সাবেক পিডি নূর আহমদকে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (ইস্ট জোন) হিসাবে নিয়োগের আদেশ দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, নূর আহমদ ন্যায়ের সঙ্গে লড়ছিলেন। অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ছিলেন। অথচ তাকে পিডি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এদিকে ২৫ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়।
এতে হুন্দাই রোটেম ও প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেক্টর সিঙ্গাপুরের সিসিআইসির বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়। পাশাপাশি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। রেলপথ সচিবের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে দুই মাসের বেশি সময় ধরে তা গোপন রাখা হয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন ও ভূমি) ফারুকুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন কমিটি ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
এদিকে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলতি সপ্তাহে ইঞ্জিনগুলোর ৬৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ইঞ্জিন গ্রহণের বিষয়ে জানতে কারিগরি কমিটির সদস্য ও বাংলদেশ রেলওয়ের প্রধান যন্ত্রপ্রকৌশলী (পূর্বাঞ্চল) বোরহান উদ্দীন জানান, চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিনগুলো না আসায় এখনো গ্রহণ করা হয়নি। এখন পারফরমেন্স যাচাই করা হচ্ছে।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হুন্দাই অলটারনেটরের মডেল টিএ৯-১২সিএ৯এসই সরবরাহ করেছে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী টিএ১২-সিএ৯ সরবরাহ করার কথা ছিল। ঊর্ধ্বতন এক যন্ত্রপ্রকৌশলী জানান, দুটি মডেলের মধ্যে শক্তি উৎপাদনের সামর্থ্যে পার্থক্য রয়েছে। এ ছাড়া সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের সব রেলপথকে ডুয়েল গেজ লাইনে রূপান্তরিত করা হবে। রেলওয়েকে এমন লোকোমোটিভ কিনতে নির্দেশ দেওয়া হয় যা দিয়ে মিটার ও ব্রড উভয় গেজেই চালানো যায়। কিন্তু ইঞ্জিনগুলো ব্রড গেজে চলবে না বলে জানা গেছে।
শনিবার নতুন পিডি হাসান মনসুর যুগান্তরকে জানান, দ্রুত সময়ের মধ্যে ৬৫ শতাংশ অর্থ হুন্দাই রোটেম কোম্পানিকে প্রদান করা হবে। এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া ইঞ্জিনগুলোর ২/১টি দিয়ে কনটেইনার ট্রেন চালানো হচ্ছে। গতি ঠিকমতো উঠছে কিনা তা দেখা হচ্ছে। কনটেইনার ট্রেন চালিয়ে তো এসব ইঞ্জিনের যথাযথ গতি নির্ণয় করা সম্ভব নয়-এমন প্রশ্নের উত্তরে হাসান মনসুর বলেন, আমরা এসব ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালাতে চাচ্ছি। চুক্তি অনুযায়ী এখনো যেসব যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয়নি সেগুলো পূরণে আমরা কাজ করছি। অলটারনেটরের সংযোগের মাধ্যমে ইঞ্জিনগুলো যথাযথ করা হবে।
এ বিষয়ে রোববার সাবেক পিডি নূর আহমদ যুগান্তরকে বলেন, আমি এখন দায়িত্বে নেই। দায়িত্বে থাকার সময় ন্যায়ের সঙ্গে লড়েছি। হুন্দাই রোটেম কোম্পানির অনিয়ম, চুক্তি ভঙ্গ এবং অনিয়মের সঙ্গে জড়িত রেলওয়ে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। ৬৫ শতাংশ টাকা যাতে পরিশোধ না করা হয় সেজন্য ব্যাংকে লিখিতভাবে চিঠি দিয়ে তা স্থগিত করেছি।
আমি এ পদে থাকলে কোনো দিনই ৬৫ শতাংশ টাকা পরিশোধ করতাম না। কারণ, দেশের ক্ষতি আমি মেনে নেব কি করে! কমিটির প্রতিবেদনে শাস্তির সুপারিশ এলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। আমাকে বদলি করা হয়েছে। বদলির আদেশে আমার নাম ভুল রয়েছে। আমি এ আদেশ অনুযায়ী যোগদান করছি না। প্রয়োজনে আদালতে যাব।