ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর একটি অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীর উত্তরায় সুমিস হট কেক এ অভিযান করেছে। এতে ১০.৫২ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য পাওয়া গেছে।
ভ্যাট ফাঁকির উদ্দেশ্যে প্রকৃত বিক্রয় তথ্য গোপন এবং মেশিনে প্রস্তুতকৃত কেক হাতে তৈরির ঘোষণা দিয়ে ভ্যাট ফাঁকির দায়ে আজ ভ্যাট আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ভ্যাট ফাঁকির সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২ জুন ২০২১ তারিখে সংস্থার উপ-পরিচালক নাজমুন নাহার কায়সার ও ফেরদৌসী মাহবুব এর নেতৃত্বে ভ্যাট গোয়েন্দার একটি দল সুমিস হট কেক লিঃ, আহালিয়া, তুরাগ, প্লট-২০, রোড-১, লেন-০৪, ওয়ার্ড-৭, ব্রক-এ, ঢাকায় অবস্থিত কারখানা কাম প্রধান কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাট নিবন্ধন নং: ০০১৯২৪২৩৭-০১০২।প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটে কেন্দ্রীয়ভাবে নিবন্ধিত।
রাজধানীসহ সারাদেশে এই কেক প্রস্তুতকারীর ২৬টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে।এসব বিক্রয়কেন্দ্রে কারখানায় উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করা হয়।
অভিযানে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি হাতে তৈরির কেক ঘোষণা দিলেও মূলত মেশিনে কেক প্রস্তুত করে আসছে।মেশিনে তৈরির কেক এর উপর ১৫% হারে ভ্যাট প্রযোজ্য।কিন্তু হাতে তৈরি করলে তা ৫%।এতদিন সুমিস কেক ৫% হারে ভ্যাট দিয়েছে।
ভ্যাট গোয়েন্দার পরিদর্শনকালে ভ্যাট সংক্রান্ত নথিপত্র দেখাতে বলা হলে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহযোগিতা করেন। পরিদর্শনকালে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়ের তথ্যসহ আরো কিছু বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করা হয়।
সুমিস হট কেক এর ভ্যাট সংক্রান্ত দলিলাদি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি তিন ধরনের ভ্যাট হার বিশিষ্ট পণ্য সরবরাহ মূল্য তাদের রির্টার্নে উল্লেখ করেছে।যার মধ্যে রয়েছে আদর্শ হারে পণ্য (মূসক-১৫%), সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য পণ্য (সম্পূরক শুল্ক-১০%), আদর্শ হার ব্যতীত অন্যান্য হারে পণ্য (মূসক-৫%) ও অব্যাহতি প্রাপ্ত পণ্য।তবে রিটার্নের সংযুক্ত সাবফরম যাচাই করে দেখা যায়, মেশিনে প্রস্তুতকৃত কেক ও অন্যান্য কেক এর মূল্য রিটার্নের নোট-৭ এ উল্লেখ করে এবং এর উপর ৫% ভ্যাট পরিশোধ করা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে উক্ত পণ্যের উপর আদর্শহারে ভ্যাট (মূসক-১৫%) প্রযোজ্য হবে। কারণ সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির সকল ধরনের কেক মেশিনে প্রস্তুত করা হচ্ছে।
পরিদর্শনকালে প্রতিষ্ঠানের কারখানায় স্থাপনকৃত কেক মিক্সিং মেশিন – ৬টি, অটো ওভেন (ক্যাপাসিটি ১০৫টি) – ২টি, বিস্কুট প্রস্তুতের বড় অটো ওভেন – ১টি, ক্রিম মিক্সিং মেশিন – ১টি দেখতে পাওয়া যায়।কেক তৈরিতে এসব মেশিন ব্যবহার হচ্ছে।
পরিদর্শনকালে কেক প্রস্তুতের সিনিয়র সেফ এর সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের কারখানায় কয়েকটি ধাপে কেক প্রস্তুত করা হয়ঃ ১. মিক্সিং মেশিনে ডিমের ফোম প্রস্তুত করা; ২. ডিমের ফোমের সাথে অন্যান্য উপকরণ দিয়ে মিক্সিং মেশিনে ৩০ মিনিট মিশিয়ে কেক এর বেটার প্রস্তুত করা; ৩. কেক বেটার ডাইসে ঢেলে অটোমেটিক ওভেনে ৩০ মিনিট রেখে বেক করা; ৪. ডেকোরেশনের জন্য মিক্সিং মেশিনে ক্রিম প্রস্তুত করা; ৫. ওভেনে বেক করা কেকের উপর ক্রিম দিয়ে ডিজাইন করা; ৬. সরবরাহের জন্য তা বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়।
আলোচ্য প্রতিষ্ঠানের কারখানায় কেক প্রস্তুতের জন্য কিছু কাজ হাতে (যেমনঃ বস্তা থেকে ময়দাসহ অন্যান্য উপকরণ মিক্সিং মেশিনে ঢেলে দেয়া, কেক এর বেটার মিক্সিং মেশিন থেকে নামানো, ক্রিম দিয়ে ডিজাইন ইত্যাদি) করা হলেও কেক প্রস্তুতের মূল কাজ মেশিনে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি কেক তৈরির মূল প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন ধরনের মেশিনের মাধ্যমে সম্পন্ন করেও হাতে তৈরি কেক এর হার অনুযায়ী ভ্যাট প্রদান করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছিল।
মামলার প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রস্তুতকৃত কেক মেশিনে প্রস্তুত বিবেচনায় নিয়ে তার উপর আদর্শহারে ভ্যাট আদায়যোগ্য।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, একই প্রক্রিয়ায় অন্যান্য কেক প্রস্তুতকারকগণ ১৫% হারে ভ্যাট দিয়ে আসছে।সুমিস হট কেক কম ভ্যাট দেয়ায় অন্যান্য প্রস্তুতকারকগণ ক্ষতির মুখে পড়েছে।
প্রতিষ্ঠানের জুলাই/২০১৯ থেকে এপ্রিল/২০২১ সময়ের দাখিলপত্র অনুযায়ী মেশিনে প্রস্তুত কেক এর সরবরাহ মূল্য ২৬,৯০,০০,৭২৬ টাকা।উক্ত কেকসমূহ মেশিনে প্রস্তুত করা হলেও প্রতিষ্ঠানটি (হাতে তৈরি কেক হিসেবে ৫% হারে) ভ্যাট প্রদান করে ১,৩৪,৫০,০৩৬ টাকা।কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির জন্য প্রযোজ্য আদর্শ হার হলো ১৫%। বিধায় ৪,০৩,৫০,১০৯ টাকা ভ্যাট প্রযোজ্য।সে বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানটির অপরিশোধিত ভ্যাট এর পরিমাণ ২,৬৯,০০,০৭৩ টাকা।এই ভ্যাট যথাসময়ে পরিশোধ না করায় ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক ২% হারে সুদ ৬০,২২,৬৬৯ টাকা প্রযোজ্য।
এছাড়া প্রতিষ্ঠান থেকে জব্দকৃত সি.এ. রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, জুলাই/২০১৬ হতে জুন/ ২০১৯ পর্যন্ত সময়ে প্রকৃত বিক্রয়মূল্য ৫৫,৫৫,১২,৮৬৫ টাকা।কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ দাখিলপত্রে বিক্রয়মূল্য ২৫,৮৫,৭১,৮৬১ টাকা প্রদর্শন করেছে।এর মাধ্যমে সুমিস কেক ২৯,৬৯,৪১,০০৪ টাকা বিক্রয়মূল্য কম প্রদর্শন করেছে।কম পরিশোধিত বিক্রয়মূল্যের উপর ১৫% হিসেবে ৮,৩৩,২৬,৯৩০ টাকা ভ্যাট প্রযোজ্য।এই সময়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ৩,৮৯,২৬,৮৫৯ টাকা ভ্যাট প্রদান করেছেন।অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের পরিহারকৃত ভ্যাট এর পরিমাণ ৪,৪৪,০০,০৭১ টাকা।এই ভ্যাট যথাসময়ে পরিশোধ না করায় ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক ২% হারে সুদ বর্তায় ২,৭৮,৪২,০৯৬ টাকা।
প্রতিবেদন অনুসারে, সুমিস হট কেক জুলাই/২০১৬ হতে এপ্রিল/২০২১ পর্যন্ত ৭,১৩,০০,১৪৩ টাকা ভ্যাট পরিহার করেছে এবং এই পরিহারকৃত ভ্যাট এর উপর সুদ বাবদ ৩,৩৮,৬৪,৭৬৫ টাকাসহ সর্বমোট ১০,৫১,৬৪,৯০৯ টাকা আদায়যোগ্য হবে।
তদন্তে উদ্ঘাটিত ভ্যাট ফাঁকির টাকা আদায়ের আইনগত কার্যক্রম গ্রহণের জন্য মামলাটি ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটে প্রেরণ করা হবে।একইসাথে এখন থেকে যথানিয়ম ও হারে ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট স্থানীয় ভ্যাট কার্যালয়কে সুপারিশ করা হবে।
সূত্র: কালের কন্ঠ