জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন পটিয়া আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা। তিনি তার বশংবদ ‘এমপি লীগ’ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দলের নির্বাচিত কমিটি ভেঙে দিয়ে জামায়াত-হাইব্রিড-অনুপ্রবেশকারীদের ঠাঁই দিচ্ছেন।
এতে বলা হয়, ‘আমরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সাংগঠনিক নিয়মে গঠনতন্ত্র অনুসারে সাংগঠনিক এবং দলীয় সব কর্মকাণ্ড সুচারুরূপে পরিচালনা করে আসছি। পরিতাপের বিষয়, সম্প্রতি কোনো প্রকার সভা, সম্মেলন না করে এবং আমাদের কোনোরূপ চিঠি বা মৌখিকভাবে অবগত না করে উপজেলা আওয়ামী লীগ হঠাৎ করে অগঠনতান্ত্রিকভাবে পটিয়া উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। আরও দুঃখের বিষয়, বিভিন্ন দল থেকে আগত অনুপ্রবেশকারী, পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগবিদ্বেষী, কট্টর সাম্প্রদায়িক ও অসাংগঠনিক ব্যক্তিদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে অন্যায়ভাবে কমিটি ঘোষণা করা হয়। যার দরুণ দলীয় ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। ’
সূত্রমতে, পটিয়া উপজেলার ১৪ নম্বর ভাটিখাইন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন সন্তোষ কুমার বড়ুয়া। ৭৪ বছর বয়সী এই সাবেক স্কুলশিক্ষক কয়েক দশক ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত। তিনি স্থানীয় নলিনীকান্ত মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করতে কাজ করতেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ভাটিখাইন ইউনিয়নে হাতে গোনা যে দু-চার জন আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রেখেছিলেন তার অন্যতম সন্তোষ কুমার বড়ুয়া। সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত প্রবীণ এই নেতাকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে জাতীয় পার্টি থেকে আসা এক নেতাকে পদায়ন করা হয়েছে। শুধু সন্তোষ কুমার বড়ুয়াই নন, চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ১৪ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি সাংগঠনিক নিয়মবহির্ভূতভাবে ভেঙে দিয়ে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত থেকে আসা অনেক নেতাকে নিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর শোকের মাস আগস্টে আওয়ামী লীগের কোনো স্তরেই কমিটি গঠনের রেওয়াজ না থাকলেও পটিয়ায় এমনটাই করা হয়েছে। সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গঠিত ১৪টি ইউনিয়ন কমিটি ২০১৯ সালের আগস্টে ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণা হয়। এমন কান্ডের পেছনের ব্যক্তিটি হলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী।
হুইপ সামশুল, তার দুই ভাই ও এক ছেলের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগের অন্ত নেই। মতের অমিল হলেই পুরনো ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্যাতন ও অপমান, জবরদখল, দলীয় পদ বাণিজ্য, অনিয়ম-দুর্নীতির বহু অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। সোমবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে পটিয়া আওয়ামী লীগের নেতারা নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। ১৪ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের কাছে লিখিত অভিযোগও দেন। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কিছু অভিযোগ পেয়েছি। আমরা তদন্ত করছি। তদন্তের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সামশুল হকের সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে যোগসাজশে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে ১৪ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের আগস্টে এ কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। যদিও আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কোনো পর্যায়ের কমিটিই শোকের মাস আগস্টে গঠন করা হয় না। নতুন গঠিত এসব কমিটিতে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি থেকে আসা অনেক নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়। অসাংগঠনিকভাবে কমিটি ভেঙে দেওয়া ও অনুপ্রবেশকারীদের কমিটিতে স্থান দেওয়ার বিষয়টি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন তৃণমূল নেতারা।
কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে পাঠানো অভিযোগপত্রে পটিয়ার বিভিন্ন ইউনিয়নের ১৩ জন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, কেন্দ্রীয় নেতারা অভিযোগগুলো আমলে নিয়েছেন। তারা সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটি পুনর্বহাল হবে বলে জানিয়েছেন। সামশুল হকের অনুসারীদের নিয়ে গঠিত কমিটিগুলো ভেঙে দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
কমিটি ভেঙে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে কোলাগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভেঙে দেওয়া কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ হারুন বলেন, ‘পুরনো ও ত্যাগী আওয়ামী লীগের নেতারা টাকাপয়সার লোভ করেন না। তারা দল নিয়ে ভাবেন, দলের ভাবমূর্তি রক্ষায় কাজ করেন। টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় সুবিধাবাদী লোক ঢুকে গেছে। তারা আমাদের মতো পুরনো নেতাদের কারণে অপকর্ম করতে পারেন না। সেজন্য আমাদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করেছিল। ’
কমিটি ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে খেপে যান হুইপ সামশুল হকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম শামসুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এটা আপনার জানার প্রয়োজন কী? এখানে আমার দলের ভালোমন্দ আমি বুঝতেছি। যেটা ভালো সেটা করতেছি। ’
সোমবার দুপুরে সার্কিট হাউসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক দিদারুল আলম চৌধুরী। প্রবীণ এই নেতা বলেন, ‘সামশুল হক চৌধুরী নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করে দলকে বিতর্কিত করছে। তার কর্মকাণ্ডে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ’
এ সময় তিনি সামশুল হকের নানা অপকর্মের কথা তুলে ধরতে চাইলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন তাকে থামিয়ে দেন। সভায় আরও কয়েকজন নেতা সামশুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দিদারুল আলমকে থামিয়ে দেওয়ায় অন্যরা আর কথা বলেননি। তবে ১৪ ইউনিয়নের সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দেন।