প্রস্তাবিত ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শিক্ষা আইন (চূড়ান্ত), ২০২১- অসঙ্গতি বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। এতে চরম ক্ষুব্ধ খাত সংশ্লিষ্ট অসংখ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তাদের মতে, প্রস্তাবিত এই আইন পাস হলে মাঠ পর্যায়ের ১২ হাজার চিকিৎসক বেকারের তালিকায় নাম লেখাতে বাধ্য হবেন। তাদের চিকিৎসা পেশা পড়ে যাবে চরম অনিশ্চয়তায়। কেননা প্রস্তাবিত আইনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক বোর্ড এবং তৃতীয় অধ্যায়ে বাংলাদেশ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কাউন্সিল গঠন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু একই আইনের অধীনে দুটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করার বিধান থাকা বিদ্যমান আইনি রীতির সঙ্গে মারাত্মকভাবে সাংঘর্ষিক। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রস্তাবিত আইনের আগের খসড়ার ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক খাতের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া ছিল। কিন্তু নতুন প্রস্তাবিত খসড়ায় পুরো ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা সংক্রান্ত নির্দেশনা বাদ দেয়ায় ইউনানী-আয়ুর্বেদিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিকাশ রুদ্ধ ও পঙ্গু হতে যাচ্ছে।
এতে ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করে বাংলাদেশ দেশীয় চিকিৎসক সমিতি, বাংলাদেশ আয়ুর্বেদিক মেডিকেল এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ইউনানী মেডিকেল এসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত আইন পাস হলে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে স্বপ্ন ও উন্নয়ন পরিকল্পনা ধুলিস্যাৎ হবে। অবিলম্বে তারা এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ইউনানী-আয়ুর্বেদিক খাতের হাজার হাজার উদ্যোক্তা। তাদের দাবি, বিদ্যমান অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, ইউনানী-আয়ুর্বেদিক খাতের অভিভাবক সংস্থা বাংলাদেশ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক বোর্ডের কোনো মতামত গ্রহণ করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ধৃষ্টতা ও সীমা লঙ্ঘনের পরিচয় দিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কতিপয় কর্তাব্যক্তি। গত ২৭শে মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সোলতান আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগের উপ-সচিব রাজীব হাসান মতামত দিয়ে বলেন, একই আইনের অধীনে দুটি আইনগত সত্ত্বা প্রতিষ্ঠিত হবার নজির বাংলাদেশে নেই। তার আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, একই আইনে ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক বোর্ড এবং বাংলাদেশ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা সাংঘর্ষিক কি না- এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগের মতামত নিতে হবে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের মতামত গ্রহণ না করে কিছু কাটছাট করে একতরফাভাবে প্রস্তাবিত ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শিক্ষা আইন(চূড়ান্ত), ২০২১- বিল আকারে উত্থাপনের জন্য ফের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রেরণ করা হয়। বাংলাদেশ আয়ুর্বেদিক মেডিকেল এসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রব খান বলেন, নতুন আইন পাস হবার সঙ্গে সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের ১২ হাজার চিকিৎসক বেকারের তালিকায় নাম লেখাতে বাধ্য হবেন। তাদের চিকিৎসা পেশাজীবন পড়ে যাবে চরম অনিশ্চয়তায়। কারণ চলমান অর্ডিন্যান্সের ২৪ ধারায় ১২ হাজার ট্রাডিশনাল হিলার বা মাঠ পর্যায়ের চিকিৎসকদের বি-ক্যাটাগরি রেজিস্ট্রেশন প্রদান করে চিকিৎসা সেবার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। প্রস্তাবিত আইনে ২৪ ধারা বিলুপ্ত করা হয়েছে। ফলে তৈরি হতে যাচ্ছে ভয়াবহ সংকট ও আতঙ্ক।
বাংলাদেশ ইউনানী মেডিকেল এসোসিয়েশনের মহাসচিব আখ মাহবুব রহমান বলেন, বিদ্যমান অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ অনুযায়ী, ইউনানী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার অধিকার এবং নিজস্ব চেম্বারে রোগী দেখা ও ফি গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া আছে। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনের চূড়ান্ত খসড়ায় এই বিধান বিলুপ্ত করে আইন আমান্যকারীদের মোবাইল কোর্টে দণ্ড আরোপের ব্যবস্থা, ১ বছরের কারাদণ্ড অথবা নগদ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড; এমনকি জামিন অযোগ্য শাস্তির বিধান সংযোজন করা হয়েছে। এতে চিকিৎসকদের অধিকার যেমন খর্ব হবে, ঠিক তেমনি সংকুচিত হবে ইউনানী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার বিকাশ।
বাংলাদেশ আয়ুর্বেদিক ওষুধ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, প্রস্তাবিত আইনে ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক বোর্ড এবং বাংলাদেশ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কাউন্সিলের কার্যাবলী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মারাত্মক বিরোধের বিধান সংযোজন করা হয়েছে। ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক বোর্ডকে ডিপ্লোমা ইউনানী আয়ুর্বেদিক কলেজের স্বীকৃতি এবং নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের একাডেমিক মান নিয়ন্ত্রণ, তদারকি, পরিদর্শন, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ন্যস্ত করা হয়েছে বাংলাদেশ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিক্যাল কাউন্সিলের ওপর। ফলে দুটি সংস্থাকে ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব ও সাংঘর্ষিক অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নিশ্চিতভাবেই ইউনানী-আয়ুর্বেদিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হবে। আর সংস্থা দুটি’র মধ্যে তৈরি হবে ভারসাম্যহীনতা। একই আইনে দুই সংস্থার এ রকম নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দেয়ার বিধান বাংলাদেশের আর কোনো আইনে নেই।সূত্র জানায়, বিদ্যমান বাংলাদেশ ইউনানী অ্যান্ড আয়ুর্বেদিক প্র্যাকটিশনার্স অর্ডিন্যান্স-১৯৮৩-এর হালনাগাদ ও বাংলা অনুবাদ করে নতুন আইন তৈরির কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। এরপর মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করা হয় ‘বাংলাদেশ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি আইন-২০১৬’-এর খসড়া। এ খসড়াকে যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করতে ২০১৮ সালের ১৫ই মে তৎকালীন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেককে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় ৮ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি। যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে ২০১৮ সালের ১৮ই অক্টোবর উক্ত কমিটি ‘বাংলাদেশ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি আইন-২০১৬’-এর খসড়া অনুমোদন করে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের সুপারিশ করে। কিন্তু ২০২০ সালের ৫ই আগস্ট হঠাৎ করে ‘বাংলাদেশ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি আইন-২০১৬’-এর অনুমোদনকৃত খসড়াকে ধামাচাপা দিয়ে বাংলাদেশ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শিক্ষা আইন-২০২০ শিরোনামে আরেকটি হ-য-ব-র-ল এবং ভয়াবহ সাংঘর্ষিক খসড়া আইন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।