ধর্ম ডেস্ক :
কোনো ধর্মের দেব-দেবীকে কটূক্তি করার কথা ইসলাম বলেনি। বরং তা থেকে বিরত থাকতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। কোনো ধর্মের উপাস্য বা দেব-দেবী নিয়ে কটূক্তি বা সম্মানহানীকর কটাক্ষ করার অনুমোদন ইসলামে নেই। বরং ইসলামই হচ্ছে সহনশীলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যে জীবন ব্যবস্থায় উচ্ছৃঙ্খলতার লেশমাত্র নেই।
যদি কোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠী অন্য ধর্মের দেব-দেবীর প্রতি কটূক্তি করে; তবে তা ইসলামের উপর বর্তাবে না বরং তা তার ব্যক্তিগত বিষয়। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর প্রতি এ ব্যাপারে কতই না সুন্দর নসিহত পেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلاَ تَسُبُّواْ الَّذِينَ يَدْعُونَ مِن دُونِ اللّهِ فَيَسُبُّواْ اللّهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ كَذَلِكَ زَيَّنَّا لِكُلِّ أُمَّةٍ عَمَلَهُمْ ثُمَّ إِلَى رَبِّهِم مَّرْجِعُهُمْ فَيُنَبِّئُهُم بِمَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ
‘আল্লাহকে ছেড়ে তারা যাদের আরাধনা করে, তোমরা তাদেরকে মন্দ বলো না। তাহলে তারা ধৃষ্টতা দেখাতে গিয়ে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গাল-মন্দ করবে। এমনিভাবে আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে তাদের কাজ-কর্মকে সুশোভিত করে দিয়েছি। অতপর স্বীয় পালনকর্তার কাছে তাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন তিনি তাদের বলে দেবেন যা কিছু তারা করত।’ (সুরা আনআম : আয়াত ১০৮)
তাফসিরে জালালাইনে এ আয়াতের ব্যাখ্যা এভাবে করা হয়েছে-
আল্লাহ তাআলা বলেন-‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে (যেসব প্রতিমাসমূহকে) তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। তাহলে তারা অজ্ঞানতাবশত (আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞনতার কারণে) সীমালঙ্ঘন করে (অন্যায়ভাবে ও সীমাতিক্রম করে) আল্লাহকে গালি দেবে!
আয়াতের শানে নুজুল
দেব-দেবী বা অন্য ধর্মের উপাস্যদের গালি না দেয়া সম্পর্কিত আয়াত নাজিলের পেছনে যে কারণ নিহিত, তাহলো-
মক্কার সর্দাররা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা আবু তালেবকে বললেন, আপনি আমাদের মান্যবর সর্দার। আপনার ভাইয়ের ছেলে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের এবং আমাদের উপাস্যদের ভীষণ কষ্টে ফেলে রেখেছেন। আমাদের অনুরোধ যে, তিনি যদি আমাদের উপাস্যদের মন্দ না বলেন, তবে আমরা তার সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করবো। তিনি যেভাবে ইচ্ছা নিজ ধর্ম পালন করবেন। যাকে ইচ্ছা উপাস্য করবেন; আমরা কিছুই বলব না।
চাচা আবু তালেব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ডেকে বললেন, এরা সমাজে সর্দার, আপনার কাছে এসেছেন। তখন বিশ্বনবি তাদের সম্বোধন করে বললেন, আপনারা কী চান?
তারা বলল, আমাদের বাসনা, আপনি আমাদের এবং আমাদের উপাস্যদের মন্দ বলা থেকে বিরত থাকুন। আমরাও আপনাকে এবং আপনার উপাস্যকে মন্দ বলব না। এভাবে পারস্পরিক বিরোধের অবসান হবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আচ্ছা! আমি যদি আপনাদের কথা মেনে নিই, তবে আপনারা কি এমন একটি বাক্য উচ্চারণ করতে সম্মত হবে; যা উচ্চারণ করলে সমগ্র আরবের প্রভু হয়ে যাবেন এবং অনারবরাও আপনাদের অনুগত ও করদাতায় পরিণত হয়ে যাবে?
আবু জাহেল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, এরূপ বাক্য একটি নয়, আমরা ১০টি উচ্চারণ করতে পারি। বলুন বাক্যটি কী?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। এ কথা শুনেই তারা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
তখন আবু তালিবও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, ভাতিজা! এ কালেমা ছাড়া অন্য কোনো কথা বলুন। কেননা, আপনার সম্প্রদায় এ কালেমা শুনেই ঘাবড়ে গেছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, চাচাজান! আমি এ কালেমা ছাড়া অন্য কোনো কালেমা বলতে পারি না। যদি তারা আকাশ থেকে সূর্য নিয়ে এসে আমার হাতে রেখে দেয়, তবুও আমি এ কালেমা ছাড়া অন্য কিছু বলব না। এভাবে তিনি কুরাইশ সর্দারদের নিরাশ করে দেন। এতে কুরাইশরা অসন্তুষ্ট হয়ে যায়।
কুরাইশদের সিদ্ধান্ত ও আল্লাহর নির্দেশ
এরপর কুরাইশরা বলেন, হয় আপনি আমাদের উপাস্য প্রতিমাদের মন্দ বলা বিতর হবেন; না হয়- আমরা আপনাকে গালি দেব এবং ওই সত্ত্বাকেও গালি দেব; আপনি নিজেকে যার রাসুল বলে দাবি করেন। কুরাইশদের এ কথার প্রেক্ষিতে এ আয়াত নাজিল হয়-
‘আল্লাহকে ছেড়ে তারা যাদের আরাধনা করে, তোমরা তাদেরকে মন্দ বলো না। তাহলে তারা ধৃষ্টতা দেখাতে গিয়ে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গাল-মন্দ করবে। এমনিভাবে আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে তাদের কাজ-কর্মকে সুশোভিত করে দিয়েছি। অতপর স্বীয় পালনকর্তার কাছে তাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন তিনি তাদের বলে দেবেন যা কিছু তারা করত।’ (সুরা আনআম : আয়াত ১০৮)
অতপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার অনুসারী তথা মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশ্যে কুরআনুল কারিমে ঘোষিত দেব-দেবী বা প্রতিমাসমূহকে মন্দ বলার বিষয়টি সুস্পষ্টভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, ‘যারা ইসলাম ব্যতিত অন্য ধর্ম অবলম্বন করে, তাদের কিংবা তাদের দেব-দেবী কিংবা উপাস্য প্রতিমাসমূহকে গাল-মন্দ করা যাবে না। যদি কেউ অন্য ধর্মের কাউকে গাল-মন্দ করে তবে তারা আল্লাহ তাআলাকে গালমন্দ করার ধৃষ্টতা দেখাবে।
সুতরাং ইসলামের নির্দেশনা হলো- অন্য ধর্মের দেব-দেবী, প্রতিমাকে মন্দ বলা যাবে না। এমনকি অন্য কোনো ধর্ম নিয়েও বাড়াবাড়ি করা যাবে না। যেমন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। তিনি বলেন-
لاَ إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىَ لاَ انفِصَامَ لَهَا وَاللّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
দ্বীনের (ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থার) ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতা নেই। নিসন্দেহে হেদায়াত গোমরাহী থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এখন যারা গোমরাহকারী ‘তাগুত’দের মানবে না এবং আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল যা ভেঙে যাবার নয়। আর আল্লাহ সবই শুনেন এবং জানেন।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৫৬)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআনের নির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। অন্য ধর্মের লোক কিংবা ধর্মের দেব-দেবী ও উপাস্য তথা প্রতিমাসমূহ সম্পর্কে কটূক্তি বা কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।