বিগত ১২ /১৩ বছর আগের সময়ের কথা সবারই মনে আছে, যখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮/১০ ঘণ্টাই লোডশেডিং থাকতো। তপ্ত দুপুর ও সন্ধ্যা রাত এ লোডশেডিং স্থানিয় ভাষায় কারেন্ট জাওয়ার ভোগান্তি ছিল একটি সয়ে যাওয়া অসহ্য দুর্ভোগ। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের দরুন সমাজ জীবনের সকল বিভাগের স্থবিরতা কতোইনা পিছিয়ে দিয়েছিল জীবন এ্রর মান। কিন্তু বর্তমানে দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদার আলোকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা যেমন বেড়েছে তেমনি সর্বোচ্চ উৎপাদনের পরিমাণও বেড়েছে। ১৯৭০-৭১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ২২৫ মেগাওয়াট যা ২০২১ সালের ১৮ জুলাই মাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৩ হাজার ৭৯৩ মেগাওয়াট।২০০৯ সালের ৬ জুন বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ৩ হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট। এছাড়া বর্তমানে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ৯৬ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যদি একক উন্নয়ন বলতে হয় সেটা প্রথমেই আসে বিদ্যুৎ। এটা কারোর অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের জীবনে বিদ্যুতের দরকার। জীবনে খাবারের যেমন দরকার, তেমনি উন্নয়নে বিদ্যুৎও দরকার রয়েছে। বিদ্যুতের অপর নাম শক্তি। বর্তমান সরকারের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার ফলেই বিদ্যুৎ খাত এগিয়ে যাচ্ছে। সামনে বিদ্যুতের উৎপাদন আরো বাড়বে। শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পাবে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে নিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার ৫৩৩ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। এর মধ্যে সরকারি খাতে ৩৫ হাজার ১০৭ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা, বেসরকারি খাতে ২৮ হাজার ৬৪০ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে এবং ৬ হাজার ৭৮৬ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে। নিট উৎপাদনের ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ সরকারি খাতে, ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ বেসরকারি খাতে এবং ৯ দশমিক ৬ শতাংশ বিদ্যুৎ পার্শ্ববর্তী দেশ হতে আমদানি করা হয়েছে। দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় সিংহভাগ প্রাকৃতিক গ্যাস নির্ভর। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী আমদানিসহ দেশে নিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিলো ৭০ হাজার ৫৩৩ গিগাওয়াট ঘণ্টা যার প্রায় ৬৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাস জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের সরকারি খাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২১১ বিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে জ্বালানি হিসেবে প্রথম কয়লা ব্যবহার করা হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার দাঁড়ায় ৮২৫ হাজার টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারি খাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের পরিমাণ যথাক্রমে ৬১৫ ও ৭৯৫ মিলিয়ন লিটার। জ্বালানি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশের কৃষি, শিল্প, সেবাখাতসহ দৈনন্দিন জীবনে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সম্পদের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচকের ঊর্ধ্বগতি নিশ্চিত করতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানির যোগান একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ০৫টি গ্যাসক্ষেত্র ব্রিটিশ তেল কোম্পানি ‘শেল অয়েল’ এর কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ক্রয় করার দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে দেশজ জ্বালানি নির্ভর অর্থনীতির সূচনা হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেওয়ার পর থেকে তুলনামূলক সাশ্রয়ী জ্বালানির উৎপাদক হিসেবে এ গ্যাসক্ষেত্রগুলো দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে এবং জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বঙ্গবন্ধুর জ্বালানি নীতি অনুসরণ করে বর্তমান সরকার দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, নতুন নতুন জ্বালানির উৎস উদ্ভাবন, জ্বালানি সমৃদ্ধ দেশসমূহের সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বিদ্যুৎ মূল চালিকা শক্তি। দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মোট উৎপাদনের পরিমাণও বাড়ানো হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা: ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছিল ১৮ হাজার ৯৬১ মেগাওয়াট যা নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং ক্যাপটিভসহ ২২ হাজার ৫১ মেগাওয়াট। ১৯৬৮-৬৯ সালে স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ৩৬০ মেগাওয়াট। এছাড়া ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে ৬৬০, ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে ৮১৩, ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৫০, ২০০০-০১ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৫ হাজার ৭১৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছিল। অথচ শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর এক লাখে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৭৯৩ মেগাওয়াটে। তবে ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট।২০১৯ সালে বিদ্যুৎ গ্রাহক সংখ্যা ১ কোটি ৮ লাখ থেকে বেড়ে প্রায় ৭ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ খাতে বার্ষিক বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। এখন মোট বরাদ্দ বেড়ে হয়েছে ২১ হাজার ৮৩ কোটি টাকা।মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্ভাবনী উদ্যোগ ৬: “ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ” বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ ইতোমধ্যে রূপকল্প ২০২১: ‘২০২০ সালের মধ্যে সবার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে মান সম্মত বিদ্যুৎ’ গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে বিদ্যুৎখাতের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিদ্যুৎখাতের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যেই দেশের ৯৫ শতাংশ জনগোষ্ঠি বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। অবশিষ্ট জনগোষ্ঠি মুজিব বর্ষের মধ্যেই বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।