উচ্চ আদালতে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে সরকারি চাকরি আইনের একটি ধারা। যে ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় আদালতে চার্জশিট গ্রহণের আগে গ্রেফতার করতে হলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। এক রিট মামলায় ঐ আইনের ৪১(১) ধারায় দেওয়া সুবিধা কেন অসাংবিধানিক ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইনসচিব, জনপ্রশাসন সচিব, স্বরাষ্ট্রসচিবসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের চার সপ্তাহের মধ্যে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ গতকাল রবিবার এই আদেশ দেয়।
আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রিটকারী পক্ষের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু। তিনি বলেন, ফৌজদারি মামলায় একজন সাধারণ নাগরিককে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করে থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা হলে তাকে গ্রেফতারের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়। আইনের এই বৈষম্য কেন? রিটে সেটাই চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আদালত আমাদের যুক্তি গ্রহণ করে ঐ ধারা অসাংবিধানিক ও বাতিল প্রশ্নে রুল জারি করেছে। ২০১৮ সালে প্রণীত সরকারি চাকরি আইনের ৪১(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সহিত সম্পর্কিত অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হইবার পূর্বে তাহাকে গ্রেফতার করিতে হইলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করিতে হইবে।’ এই ধারা চ্যালেঞ্জ করেছেন সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যান।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে দুর্নীতি দমন কমিশন সংশোধন বিল, ২০১৩ পাশ হয়। এতে নতুন করে ৩২(ক) ধারা যুক্ত করে বলা হয়, এই আইনের অধীনে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা আবশ্যিকভাবে পালন করতে হবে। ফলে সরকারের অনুমোদন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, জজ, ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে দুদক কোনো মামলা করতে পারবে না। এই ধারা চ্যালেঞ্জ করে ঐ বছরই হাইকোর্টে রিট করেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে মনজিল মোরসেদ। ২০১৪ সালে ঐ রিটের রায়ে হাইকোর্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি-সংক্রান্ত দুদক আইনের ৩২(ক) ধারা অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি বলে ঘোষণা করে।
রায়ে বলা হয়, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। সংবিধানের ২৬(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন বাতিল হবে। সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো আইন যতখানি সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততটুকু বাতিল হবে। তাই সংশোধিত দুদক আইনের ৩২(ক) ধারায় একটি শ্রেণিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। সে কারণে ঐ ধারা আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ও বাতিলযোগ্য বলে ঘোষণা করা হলো।
সরকারি চাকরি আইনের ৪১(১) ধারা চ্যালেঞ্জ সাংবাদিকের
কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনের নামে জেলা প্রশাসনের একটি পুকুরের নামকরণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে ২০২০ সালের ১৩ মার্চ মধ্যরাতে বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে মোবাইল কোর্টের নামে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে মাদক পাওয়ার অভিযোগ এনে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়ে মধ্যরাতেই জেলে পাঠানো হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় গঠিত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ডিসি সুলতানা পারভীন, আরডিসি নাজিম উদ্দিন, সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এনডিসি এসএম রাহাতুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। পরে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যধারা শুরু করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, যার ধারাবাহিকতায় সুলতানা পারভীনকে দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) স্থগিত, এনডিসি রাহাতুল ইসলামের তিনটি ইনক্রিমেন্ট কর্তন, আরডিসি নাজিম উদ্দিনকে নিম্ন ধাপে নামিয়ে দেওয়া এবং রিন্টু বিকাশ চাকমাকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এদের মধ্যে এনডিসি রাহাতুল ইসলামকে বরিশাল ডিসি অফিসে পোস্টিং দেওয়া হয়। এসব পোস্টিংয়ের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টদের একটি আইনি নোটিশ দেওয়া হয়। নোটিশের জবাব না পাওয়ায় হাইকোর্টে রিট করা হয়। রিটে সরকারি চাকরি আইনের ৪১(১) ধারাও চ্যালেঞ্জ করা হয়।
রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও রাহাতুল ইসলামকে বরিশাল ডিসি অফিসে দেওয়া পোস্টিং (সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে। একই সঙ্গে ঐ মামলার অপর তিন জনকে পোস্টিং না দেওয়ার বিষয়ে বিরত থাকতে বিবাদীদের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তা-ও জানতে চেয়েছে আদালত। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু। তাকে সহযোগিতা করেন আইনজীবী ইশরাত হাসান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।
আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও চার জনের মধ্যে এক জনকে পদায়ন করা হয়েছে। এই চার জন ফৌজদারি মামলার আসামি হয়েও গত দেড় বছরে কোনো আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেননি। তাই আইনের দৃষ্টিতে তারা পলাতক। পলাতক ব্যক্তির সরকারি অফিসে কোনো পোস্টিং হতে পারে না।