বিশ্বের ৩৫ রাষ্ট্রনেতা, তিন শতাধিক সরকারি কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, শতাধিক ধনকুবেরের গোপন সম্পদ ও লেনদেন ফাঁস করেছে ‘প্যান্ডোরা পেপারস’। এর মাধ্যমে গ্রিক উপকথায় বিশ্বের প্রথম মানবী প্যান্ডোরার বাক্সের মতোই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে বিশ্বের প্রভাবশালীদের গোপন সম্পদের তথ্য।
প্যান্ডোরা পেপারসে প্রকাশিত নথিগুলো নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের যৌথ অনুসন্ধান ‘বহু বাক্স খুলে দিচ্ছে’ বলে ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) প্রতিবেদনের নাম দিয়েছে ‘প্যান্ডোরা পেপারস’। যৌথ অনুসন্ধানে সংবাদমাধ্যমগুলো প্রায় এক কোটি ২০ লাখ দলিলপত্র হাতে পেয়েছে।
বিবিসি প্যানোরামার প্রকাশ করা এসব নথিতে ৩৫ জন রাষ্ট্রনেতার তথ্য মিলেছে। সেই তালিকায় আছেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীরা। তাদের মধ্যে কেউ এখনো পদে বহাল, কেউ সাবেক। ৩০০ কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন ৯০টির বেশি দেশের মন্ত্রী, বিচারক, মেয়র, সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা। আর শতাধিক ধনকুবেরের যে তথ্য এসেছে, তাদের মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়ী নেতা, বিনোদন জগতের তারকা।
নথির সূত্রে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লন্ডনে একটি অফিস কেনার সময় সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও তার স্ত্রী শেরি ব্লেয়ারের তিন লাখ ১২ হাজার পাউন্ডের কর ফাঁকি দেওয়ার তথ্য প্যান্ডোরার নথিতে এসেছে। তারা একটি অফশোর ফার্ম কিনেছিলেন, যার মালিকানায় ছিল ওই ভবনটি।
প্যান্ডোরার তালিকায় রয়েছেন জর্ডানের বাদশা আবদুল্লাহ ব্রিটেনও। তিনি গোপনে মালিবু এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। এছাড়া লন্ডন ও দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডে অন্তত ৮টি স্থানে সম্পত্তি কিনেছেন।
চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী কীভাবে ফ্রান্সের দক্ষিণে এক কোটি ২০ লাখ পাউন্ডের দুটো ভিলা কেনার ক্ষেত্রে অফশোর কোম্পানিকে কাজে লাগানোর বিষয়টি চেপে গেছেন, তাও প্রকাশ পেয়েছে ফাঁস হওয়া নথিতে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মোনাকোয় বান্ধবীর জন্য বিলাসবহুল বাড়িসহ আরো বিভিন্ন সম্পদ কিনেছেন অফশোর মাধ্যমে।
আজারবাইজানের ক্ষমতাসীন অলিয়েভ পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অর্থ লুকাতে এ পরিবার একটি বিশাল অফশোর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা যুক্তরাজ্যে ৪০ কোটি পাউন্ডের সম্পত্তি কেনাবেচায় জড়িত বলে উঠে এসেছে প্যান্ডোরার নথিতে।
নথিতে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা ও তার পরিবারের ছয় সদস্যের অফশোর কোম্পানি থাকার তথ্য মিলেছে। গোপন সম্পদ এবং লেনদেনের তালিকায় রয়েছেন সাইপ্রাস এবং ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্টও।
বিবিসি ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, প্রায় ৭ বছর ধরে ফিনসেন ফাইলস, প্যারাডাইস পেপারস, পানামা পেপারসের প্রতিবেদনে অনেক বিশ্বনেতার গোপন সম্পদের তথ্য ফাঁস হয়। তবে ২০১৬ সালে যখন পানামা পেপারস ঝড় তুলেছিল, তখন এটাও বলা হয়েছিল, এটা ‘গল্পের অর্ধেকটা’ মাত্র।
সেই অর্ধেক গল্পের ধারাবাহিকতায় রবিবার (৪ অক্টোবর) খুললো প্যান্ডোরা পেপারস, যার নেপথ্যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস’ (আইসিআইজে)। ৯৫ হাজার অফশোর ফার্মের প্রায় এক কোটি ২০ লাখ নথি নিয়ে ছয় শতাধিক সাংবাদিকের পরিশ্রমে ফাঁস হয়েছে ‘প্যান্ডোরা পেপারস’।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা রক্ষার কারণে অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে সম্পত্তি কেনা উচ্চ পর্যায়ের মানুষের একটি সাধারণ প্রবণতা। পানামা পেপারস বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অর্থ পাচারের তথ্য ফাঁস করেছিল। মূলত কর এড়িয়ে বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়া, সেই অর্থ পাচার করা কিংবা অবৈধ আয়ের টাকায় ক্ষমতার মালিক হওয়ার ঘটনায় বেরিয়ে এসেছিল দেড় শতাধিক রাজনীতিবিদের চেহারা।