সরকারি প্রকল্পের জন্য নির্মাণ সামগ্রী আমদানির সময় ১৬ কোটি ৯২ লাখ টাকার শুল্ককর ফাঁকি দিলেও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশনকে (সিআরবিসি) কোনো জরিমানা করেনি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ কর্তৃপক্ষ।
২০০ থেকে ৪০০ শতাংশ কর ফাঁকির জন্য জরিমানা করার বদলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ চীনা শীর্ষস্থানীয় এ প্রতিষ্ঠানকে কেবল ফাঁকি দেওয়া শুল্ক প্রদানের অনুমতি দিয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে এক নিরীক্ষায় (অডিট) চট্টগ্রাম কাস্টমস জানতে পারে, সিআরবিসি ২০১৯ সালে ৬টি চালানে ২২ হাজার ৪৫০ টন প্রিটেনশনড স্প্যান হাই স্ট্রেন্থ কংক্রিট (পিএইচসি) পাইল আমদানি করেছে। তবে এর জন্য ২১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা কর দেওয়ার কথা থাকলেও তারা মাত্র ৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা কর দিয়েছে। এসব চালান আমদানি করা হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়নে নির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের জন্য।
এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য খালাসের সময় পিএইচসি পাইলের জন্য নির্ধারিত হারমোনাইজড সিস্টেম (এইচএস) কোডের পরিবর্তে বোরিং মেশিনের জন্য ব্যবহৃত ভুল কোড ব্যবহার করে চালানগুলো খালাস দেওয়া হয়।
এ জন্য আইন অনুসারে সিআরবিসিকে ৩৩ কোটি ৮৪ লাখ থেকে ৬৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা জরিমানা করা উচিত ছিল।
২৯ জুন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনারকে দেওয়া এক বিবৃতিতে সিআরবিসি দাবি করে, ২৩ জুন ডিমান্ড নোটিশ পাওয়ার আগ পর্যন্ত এই জালিয়াতির বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা ছিল না।
বিবৃতিতে এই ঘটনার জন্য সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে দায়ী করে বলা হয়, কর পরিশোধের জন্য সিআরবিসি তাদের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এসএফ ইন্টারন্যাশনালকে ২৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে। কাস্টমস থেকে পাঠানো শুল্কায়ন কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরযুক্ত শুল্কায়ন নোটিশের ভিত্তিতে এ টাকা পরিশোধ করা হয়।
এ ব্যাপারে সিআরবিসি ঢাকা কার্যালয়ের বিজনেস ম্যানেজার ওয়াং জিনউ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘নিয়ম মেনেই আমরা কর সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করেছি। কাস্টমসের চাহিদা অনুসারে অর্থ পরিশোধ করেছি।’
প্রতারণার জন্য সিআরবিসি তাদের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেছে কিনা জানতে চাইলে জিনউ বলেন, ‘আমরা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করিনি।’
সিআরবিসি যে তাদের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের ২৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে, সেই দাবি সম্বলিত নথি জমা দেওয়ার জন্য ১১ সেপ্টেম্বর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ যে নোটিশ জারি করেছিল সে প্রসঙ্গে জিনউ সম্প্রতি জানান, তারা সেগুলো তৈরি করছেন। আশা করা হচ্ছে, কয়েক দিনের মধ্যে তা কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ভাষ্য, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সাময়িকভাবে প্রতিষ্ঠানটির বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (বিআইএন) স্থগিত করে সব ধরনের আমদানি বন্ধ করার পরই সিআরবিসি ফাঁকি দেওয়া ১৬ কোটি ৯২ লাখ টাকার শুল্ককর পরিশোধ করেছে।
এসএফ ইন্টারন্যাশনালের সত্ত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম গত ২৯ জুন কাস্টমস কমিশনারকে দেওয়া এক চিঠিতে জানান, ৬টি চালান ছাড়ের জন্য তিনি রহিম নামের একজনকে ৬৬ লাখ টাকা এবং একজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) ও কাস্টমসের অডিট তদন্ত ও গবেষণা (এআইআর) শাখাকে ১ লাখ করে টাকা দেন।
সাইফুল আরও জানান, তিনি ৮ লাখ টাকা ফেরত পেয়েছেন। বাকি ৬০ লাখ টাকা উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তিনি কাস্টমস কমিশনারকে অনুরোধ
জানান।
তবে চিঠিতে সাইফুল এই কথা উল্লেখ করেননি যে, কেন তিনি রহিমকে এত বিপুল পরিমাণের অর্থ দিয়েছিলেন। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ধারণা, রাজস্ব কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন লেনদেনের জন্য একজন মধ্যস্থতাকারীকে এই অর্থ দেওয়া হয়েছিল।
সাইফুলের চিঠির একটা অনুলিপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে আছে। তবে তিনি পরে অন্য একটি চিঠির মাধ্যমে তার এই অভিযোগ প্রত্যাহার করেন। বলেন, ‘আমি রাগের মাথায় ঘুষের কথা বলেছিলাম। পরে বুঝতে পারি যে সেটা ঠিক হয়নি। তাই আমি তা প্রত্যাহার করে নিয়েছি।’
আর নথি জালিয়াতির বিষয়ে তিনি বলেন, কাস্টমস ও আমদানিকারক বিষয়টি দেখবে।
নথি দেখে দ্য ডেইলি স্টার জানতে পেরেছে যে, চালানগুলো শুল্কায়নের সঙ্গে কাস্টমসের ৩ জন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) ও ৩ জন রাজস্ব কর্মকর্তার (আরও) পাওয়া গেছে।
যোগাযোগ করা হলে আরও আমজাদ হোসেন হাজারী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যেহেতু পণ্যগুলো সরকারি প্রকল্পের জন্য আমদানি করা হয়েছিল, তাই আমরা সেগুলো দ্রুত খালাস করার চেষ্টা করছিলাম। যে কারণে আমরা নথিগুলো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করার সুযোগ পাইনি।’
ঘুষের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঘুষের অভিযোগে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। এর মাধ্যমে কারও আর্থিক লাভ হয়নি। এটা ছিল একটা ভুল বোঝাবুঝি।’
আরেক এআরও মল্লিক সাদরিলও একই কথা বলেন।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য দ্য ডেইলি স্টার ফোনে সংশ্লিষ্ট আরও ৩ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ ছাড়া অপর কর্মকর্তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
কাস্টমস হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার শফি উদ্দিন জানান, ঘটনাটি ‘অনিচ্ছাকৃতভাবে’ ঘটার কারণে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে তারা কোনো জরিমানা করেননি। কাস্টমস আইনের ৮৩ ধারার অধীনে মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
শফি উদ্দিন বলেন, ‘এই ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে সরাসরি ঘুষের অভিযোগ আনা হয়নি। তবে চালানগুলোর অব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের আমরা চিহ্নিত করেছি। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।’
যদিও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (কাস্টম পলিসি অ্যান্ড আইসিটি) গোলাম কিবরিয়ার ভাষ্য, এইচএস কোডে পরিবর্তনের জন্য কোম্পানি যদি রাজস্ব ফাঁকি দেয় তাহলে তাকে অবশ্যই জরিমানা দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘ভুলকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে জরিমানা মওকুফের কোনো সুযোগ নেই।’
এক সূত্রের ভাষ্য, সরকারি প্রকল্পের জন্য আমদানি করা পণ্যে ভুল এইচএস কোড অনিচ্ছাকৃত ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। কোন পণ্য কি পরিমাণে আমদানি করা হবে এবং কোন এইচএস কোড এসব পণ্য যাবে তা এনবিআর আগেই তৈরি করে। ওই সূত্রের মতে, ‘রাজস্ব ফাঁকি দিতে এটি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে।’
সিবিআরসি চীনের ৪টি বৃহৎ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির মধ্যে একটি। যা বিশ্বব্যাপী সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং তথা বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প যেমন- হাইওয়ে, রেলওয়ে, সেতু, বন্দর ও টানেল নির্মাণের কাজ করে। এ প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল ও মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিকাল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পের কাজ করছে।