নিজস্ব প্রতিবেদক : খেলাপি ঋণে টানা তিন বছর শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকে। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৯২০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। কিছুদিন আগে অন্তত আরও ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি ছিল ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ। পুনঃতফসিল ও অবলোপন করে এর অধিকাংশই কমিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ঋণ জালিয়াতির কারণে সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে জনতা ব্যাংক। এই ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপির মধ্যে আছে অ্যানন টেক্স গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি জালিয়াতি করে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা এই ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ এই তিন বছর শীর্ষ খেলাপি ঋণের রেকর্ড ধরে রাখে ব্যাংকটি। তবে করোনা পরিস্থিতি ব্যাংকটির জন্য অনেকটা সুখবর নিয়ে আসে বলা যায়। আদায় না করেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে ফেলেছে ব্যাংকটি। এক্ষেত্রে ঋণ পুনঃতফসিল ও অবলোপন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের শুরুতে পুরো ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ১০ বছর পর অর্থাৎ ২০১৯ সালে শুধু জনতা ব্যাংকেই খেলাপির পরিমাণ দাঁড়ায় ২১ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের জুন শেষে বিতরণ করা ঋণের ২২ শতাংশ ছিল খেলাপি ঋণ। এক বছর পর অর্থাৎ ২০১৯ সালের জুন শেষে মোট বিতরণ করা ঋণের ৪৩ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৪, ২০১৫, ও ২০১৬ সালে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হলেও ২০১৭ সালের পর থেকে এই ব্যাংকের অবনতির চিত্র সবার চোখে পড়ে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। অথচ ছয় মাস পর অর্থাৎ ২০১৮ সালের জুন শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ৯ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। এর তিন মাস পর অর্থাৎ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ছিল ১৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। আর ওই বছরের (২০১৮) ডিসেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ১৭ হাজার ৩০৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। পরের বছর ২০১৯ সালের জুন শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা। অবশ্য পুনঃতফসিল ও অবলোপন পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ কিছুটা কমানোর চেষ্টা করে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকায়। মার্চ শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১৪ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৭ শতাংশ।
জানা গেছে, এক সময়ের সবচেয়ে ভালো ব্যাংক বলে পরিচিত জনতা ব্যাংক থেকে অ্যানন টেক্স গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে জালিয়াতি করে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ ছাড়া ক্রিসেন্ট গ্রুপও জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে।
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুছ ছালাম আজাদও মনে করেন, খেলাপি ঋণ বাড়ার জন্য দায়ী অ্যানন টেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ। তবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এদিকে ক্রিসেন্ট গ্রুপ ও অ্যানন টেক্স গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি সঙ্গে ব্যাংকটির শীর্ষপদে থাকা ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও ব্যাংকটির শীর্ষ পদে থাকা কর্মকর্তাদের ঋণ জালিয়াতি থেকে দায়মুক্তি দিতে যাচ্ছে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জনতা ব্যাংকে অ্যানন টেক্সের ২২টি প্রতিষ্ঠানের চলতি হিসাব খোলা হয়। এর মধ্যে করপোরেট শাখায় ২০টি এবং লোকাল অফিসে ২টি। ওইসব অ্যাকাউন্টে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রুপটির ঋণের স্থিতি ছিল ৫ হাজার ৭৬৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে হিসাব খোলা থেকে শুরু করে ঋণ অনুমোদন, বিতরণ, পরিবীক্ষণ এবং বারবার পুনঃতফসিলে অনেক গুরুতর অনিয়ম এবং জালিয়াতি হয়েছে। শুধু তাই নয়, ১৫টি প্রকল্প দেখিয়ে ঋণ নেওয়া হলেও ৯টি প্রকল্প স্থাপনই হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মনে করেন, জনতা ব্যাংকের দুর্নাম কম ছিল। কিন্তু সেখানে তারা থাকতে পারেনি শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে। আর ওই সব কর্মকর্তাদের শাস্তির বদলে অনেক সময় পুরস্কৃত করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে শীর্ষে জনতা ব্যাংক। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সোনালী ব্যাংক। সোনালী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের স্থিতি ১০ হাজার ১৯৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৬০৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ছিল ৬ হাজার ৩৯২ কোটি ৯৩ লাখ এবং রূপালী ব্যাংকের ৪ হাজার ১০২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের শীর্ষে রয়েছে এবি ব্যাংক। এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৭৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। ৩ হাজার ৬৯৩ কোটি ৬ লাখ টাকার খেলাপি নিয়ে সপ্তম স্থানে অবস্থান করছে বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক। এরপরে রয়েছে পদ্মা ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকটির মোট খেলাপির পরিমাণ ৩ হাজার ৩১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ৩ হাজার ২১৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা খেলাপি নিয়ে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান নবম এবং দশম স্থানে অবস্থান করছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ২ হাজার ৭৩২ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এই ১০ ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৯ হাজার ৯৬৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।