1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : জাতীয় অর্থনীতি : জাতীয় অর্থনীতি
রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৩ পূর্বাহ্ন

ধুলোয় ধূসর শহর: ঠিকাদারদের হেয়ালিপনায় নাকাল রাজধানীবাসী

রিপোর্টার
  • আপডেট : মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২০

নিজস্ব প্রতিবেদক : গ্রীষ্ম, বর্ষা কিংবা শীত। সব ঋতুতেই চলে রাজধানীর সড়কগুলোতে খোঁড়াখুড়ির অত্যাচার। কখনও ওয়াসা, কখনও ডেসকো কিংবা কখনও সিটি করপোরেশন। উন্নয়নকাজে বছরব্যাপী চলা এ খোঁড়াখুড়িতে একদিকে যেমন সড়কের ত্রাহি অবস্থা। অন্যদিকে সৃষ্টি হচ্ছে ধুলার রাজত্ব। রাজধানীয় ঢাকার সব জায়গাতে ধুলায় ধূসর প্রান্তর। ঠিক যেন বায়ূদূষণের আনুষ্ঠানিক আয়োজন!
শহরের এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে উন্নয়ন বা সংস্কার কাজ চলছে না। কোথাও সবে সড়ক খুঁড়েছে। কিন্তু খোঁড়া মাটি পড়ে আছে রাস্তার ধারে। এতে যানবাহন চলাচল কিংবা পথচারির হাঁটাহাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে মাটি। শুষ্কতায় সেসব মাটি বাতাসে মিশে ধুলা সৃষ্টি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। আবার কোথাও খোঁড়াখুঁড়ি সেরেছে। কিন্তু রাস্তায় দেওয়া হয়নি কার্পেটের (পিচ) ঢালায়। এতেও সৃষ্টি হচ্ছে ধূলার রাজত্ব। ফলে ঘটছে বায়ূদূষণের মাধ্যমে পরিবেশ ও মানবজীবনের চরম বিপর্যয়।
কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী এসব উন্নয়ন কাজে ধুলা সৃষ্টি যেন না হয় সেটি নিশ্চিত করার নির্দেশনা রয়েছে ঠিকাদারদের প্রতি। অথচ তাদের খামখেয়ালিপনায় প্রতিনিয়ত চরম বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে নগরজীবন। আবার এসব ঠিকাদারদের যারা নজরদারি করবে তারাও নির্বিকার। এতে ধুলায় ধূসর শহরে প্রতিনিয়ত নাকাল হচ্ছেন নগরবাসী। সেই সঙ্গে বাড়ছে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমাসহ নানান রোগাক্রান্তের সংখ্যা।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সঠিক নজরদারি আর ঠিকাদারদের হেয়ালিপনা-ই শহরে বায়ূ দূষণের জন্য দায়ী। যার ফল ভোগ করছে নগরবাসী। সরকারের কঠোর নজরদারি ছাড়া এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন তারা। তাই নগরবাসীর সুস্থাস্থের জন্য হলেও এ বিষয়ে সরকারকে নজর দেওয়ার আহ্বান তাদের।
বায়ূদূষণরোধে নির্মানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি পরিবেশ অধিদফতরের নির্দেশনা হলো রাজধানীতে সেবা সংস্থাগুলোর উন্নয়নকাজ পরিচালনায় ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানো, নির্মাণসামগ্রী ঢেকে পরিবহন ও মজুদ করা। যত্রতত্র ফেলে না রাখা এবং ধুলিদূষণ নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত বেষ্টনী ব্যবহার করতে হবে।
সেই সঙ্গে রাস্তার পাশে ড্রেন বা নর্দমা থেকে ময়লা বা বর্জ্য অপসারণ করে তা ফেলে না রেখে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যেতে হবে। রাস্তার নানাবিধ কাজ যথাসম্ভব রাতে করা ও নির্ধারিত স্থানটি যতদূত সম্ভব ঢেকে রাখা এবং দৈনিক একাধিকবার পানি ছিটাতে হবে। রাস্তায় বিভিন্ন সার্ভিস ফ্যাসিলিটির মধ্যে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন সংস্থার স্থাপন বা মেরামতে বার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন এবং একই রাস্তা বারবার খোঁড়াখুঁড়ি করা যাবে না।
একই সঙ্গে সার্ভিস ফ্যাসিলি স্থাপন বা মেরামত শেষে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাস্তা কার্পেটিং করে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। উন্মুক্ত স্থানে আবর্জনা রাখা ও পোড়ানো রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ধুলা যাতে না ওড়ে সে জন্য প্রতিষ্ঠানের আওতায় উন্মুক্ত স্থানে সবুজ আচ্ছাদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এসব নির্দেশনা প্রতিপালন নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে। আর এসব নির্দেশনা সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কিনা তার নজরদারির দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের।
অথচ সরেজমিনে রাজধানীর হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, আজিমপুর, মালিবাগ, রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডা, মিরপুর, উত্তরা এবং এর আশপাশের এলাকার বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে চলা উন্নয়ন ও সংস্কারকাজে কোথাও দেখা মেলেনি পরিবেশ দূষণ তথা ধুলোকণা সৃষ্টিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে। এসব এলাকার কোথাও রাস্তা খুোঁড়াখুঁড়ি পর উন্নয়ন কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু সড়কটি খোঁড়ার আগে যেমন কার্পেটিং ঢালায় ছিল। তেমনটি আর করা হয়নি। আধাকাঁচা করে রাখা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও দীর্ঘ কয়েকমাস ধরেই ড্রেন কিংবা সুয়ারেজ পাইপলাইন বসানোর কাজ চললেও শেষ হয়নি এখনও। কিন্তু কোথাও মানছে না ধুলা দূষণরোধের নির্দেশনা।
হাজারীবাগে দীর্ঘ তিনমাস ধরে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা রশিদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘তিনমাসের বেশি সময় ধরেই হাজারীবাগ এলাকায় রাস্তা কেটে ফেলে রেখেছে। কবে কাজ শেষ হবে তা কেউ জানে না। যারা কাজ করছে তারাও জানে না। কিন্তু রাস্তা কাটার সময় যেসব মাটি তুলেছিল সেগুলো এখন ধুলা হয়ে উঠতেছে। কারণ যখন মাটি কেটেছিল, তখন ছিল বর্ষা। তখন মাটি পানিতে ভেজা থাকায় সমস্যা হয় নি। কিন্তু এখন যা অবস্থা বলার মতো নয়।’
একই কথা বললেন জুরাইনের বাসিন্দা মাহমুদুল হক। তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরেই চলছে উন্নয়ন কাজ। তিনমাস কাটে। ছয় মাস কাজ বন্ধ থাকে অবস্থা। মোট কথা কবে যে কাটাকাটির কাজ বন্ধ হবে তা জানতে পারি না আমরা। কিন্তু আগে তো একদিন বৃষ্টি হলে তিনদিনও মাটি থেকে ধুলা উড়তো না। এখন তো শীতকাল। গতকয়েকদিন ধরে ধুলার পরিমাণ বেড়েছে। এমনকি একটা শার্ট একদিনের বেশি পড়া যায় না। ধুলায় ময়লা হয়ে যায়।’
তবে এমন পরিস্থিতিতে ঢাকার দুই সিটি বলছে, ধুলার দূষণ প্রতিরোধে প্রতিনিয়ত পানি ছিটানো হচ্ছে। পাশাপাশি নির্মাণাধীন কাজগুলোর মনিটরিং করছে তারা। যদিও নগরবাসী বলছেন, এমনটা তারা দেখছেন না।
মতিঝিলের একটি ভবনের নিরাপত্তা গার্ড হারিছ উদ্দিন বলেন, ‘সবসময় তো ভবনের নিরাপত্তায় থাকি। রাস্তায় পাশের রুমে ঘুমায়। কিন্তু এ বছর এখনও পানি ছিটানোর গাড়ি দেখি নি। গত বছর ছিটিয়েছিল কয়েকদিন।’
একই কথা বললেন, মিরপুর-১ এর বাসিন্দা মো. শিবলু। তিনি বলেন, পানি ছিটানোর কথা আপনার থেকেই শুনলাম। আমি তো সকালে দোকান খুলি। কই কখনও তো দেখলাম না। আর পানি ছিটালে কি ধূলাবালি থাকতো? দোকানের মালপত্র সকালে মুছলে দুপুর হতে হতে আবারও ধুলার স্তর জমে!
ধুলার দূষণরোধ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কি পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানতে চাইলে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘আমরা নিয়মিত পানি ছিটাচ্ছি। পাশাপাশি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছি যাতে ধুলার সৃষ্টি না হয়।’
একই কথা বললেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা। তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিত পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করেছি। প্রতিদিন ১০টি গাড়ি পানি ছিটাচ্ছে। পাশাপাশি ঠিকাদারদের কাজের মান যাচাই করে অনিয়ম পেলে জরিমানা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে পরিবেশ দূষণরোধে প্রতিদিন আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ মাঠে তদারকি করছেন।’
তবুও কেনো ধূলার রাজত্ব এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মুলত এটি করপোরেশন একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সেবা সংস্থাগুলোকেও আন্তরিক হতে হবে। আমরা সেদিকে জোর দিচ্ছি।
তবে নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘প্রকৃত পক্ষে সিটি করপোরেশন যদি নজরদারির কাজটি সঠিকভাবে করতে এবং অনিয়মের শাস্তি নিশ্চিত করতো তাহলে এতোটা বিপর্যয় হতো না। কিন্তু করপোরেশন-ই তো তাদের কাজটি সঠিকভাবে করছে না। তাই ঠিকাদাররাও হেয়ালিপনা করছে। ফলে সমস্যা ক্রমেই বড় হচ্ছে। আর সে সমস্যা সৃষ্টির পথ প্রতিহত না করে পানি ছিটিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এ জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্টরা-ই দায়ী।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেভাবে শহরে দূষণের আয়োজন চলছে তাতে সরকার প্রধানকেই এ জন্য কঠোর হওয়া ছাড়া সামনের আর কোনো উপায় নেই। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে বছরব্যাপী খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ এবং এর দ্বারা সৃষ্ট ঝুঁকি থেকে উত্তরণে অবশ্যই সরকার প্রধানকে নজরদিতে হবে। কারণ যারা এ সব নজরদারি করবে তারা ব্যর্থ।’

Please Share This Post in Your Social Media

এই বিভাগের আরো সংবাদ
© ২০২০ দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি