1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : জাতীয় অর্থনীতি : জাতীয় অর্থনীতি
রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩০ অপরাহ্ন

আয়কর ভীতি নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

মো. মিজানুর রহমান
  • আপডেট : রবিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২১

দেশ রক্ষা, দেশের অভ্যন্তরে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা তথা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। উন্নয়নশীল দেশে ব্যাক্তিগত প্রচেষ্টায় খুব একটা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয় না। ফলে উন্নয়নমূলক যাবতীয় কাজ সরকারকেই করতে হয়। দেশের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করার জন্য সরকার শিল্ক কারখানা ও রাস্তাঘাট নির্মান, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সরবরাহ সহ উৎপাদনের বিভিন্ন খাতে নানা সময়ে ভর্তুকি প্রদান করে। সরকারের এসমস্ত নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। সরকার এই অর্থ যে সমস্ত উৎস থেকে সংগ্রহ করে থাকে আয়কর হল অন্যতম একটি প্রধান উৎস। বাংলাদেশের সরকারি রাজস্বের প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ রাজস্ব আয়করের মাধ্যমেই সংগৃহীত হয়।
আয়কর যে কত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তা দেশের অধিকাংশ মানুষই অনুধাবন করতে পারে না। ফলে তাদের মধ্যে এক প্রকার আয়কর ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। কিš‘ আয়কর বিষয়টি মোটেও জটিল কিংবা ভীতিকর বিষয় নয়। জাতীয় রাজন্ব বোর্ড থেকে প্রতি বছর এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা সাধারন জনগনের উদ্দেশ্যে প্রচার করা হয়ে থাকে।
করমুক্ত আয়ের সীমা:
২০২০-২১ কর বছরে পুরুষ করদাতার করমুক্ত আয়ের সীমা ৩,০০,০০০ টাকা, মহিলা করদাতা ও ৬৫ বছর বা তদুর্ধ্ব বয়সের পুরুষ করদাতার ক্ষেত্রে ৩,৫০,০০০ টাকা, প্রতিবন্ধী করদাতার ক্ষেত্রে ৪,৫০,০০০ টাকা এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে ৪,৭৫,০০০ টাকা নির্ধারন করেছে সরকার। এছাড়া পূর্বের ন্যায় ঢাকা এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বসবাসরত করদাতাগনের ক্ষেত্রে ন্যুন্যতম কর ৫,০০০ টাকা, দেশের অন্যান্ন সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বসবাসরত করদাতাগনের ক্ষেত্রে ৪,০০০ টাকা এবং অন্যান্ন জেলা শহরের করদাতাদের ক্ষেত্রে ৩,০০০ টাকা এবছরও বহাল রয়েছে।

কাদের বাধ্যতামূলকভাবে আয়কর রিটার্ন সাবমিট করতে হবে ?
১. যাদের ১২ ডিজিটের কর সনাক্তকরন নম¦র ( টিআইএন) আছে,
২. যাদের বাৎসরিক আয় ন্যুন্যতম কর সীমা অতিক্রম করেছে,
৩. আয় বৎসরের কোন করদাতা যদি পূর্বের তিন বছরের যেকোন বছরে কর প্রদান করে থাকে,
৪. কারোর মাসিক মূল বেতন ১৬,০০০ টাকা অতিক্রম করলেই তাকে আয়কর দিতে হবে,
৫. করদাতা যদি কোন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী বা ব্যব¯’াপক পদে কর্মরত থাকেন,
৬. করদাতা যদি গাড়ির মালিক হন,
৭. করদাতা যদি সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করেন,
৮. করদাতা যদি কোন অংশীদারি ফার্মের মালিক হন,
৯. করদাতা যদি কোন কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত থাকেন,
১০. করদাতা যদি চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবি, চাটার্ড একাউন্টেন্ট, কস্ট এন্ড ম্যানেজমেন্টে একাউন্টেন্ট, ¯’পতি, সার্ভেয়ার বা সমজাতীয় কোন পেশাজীবি হন তাহলে তাকেও বাধ্যতামূলক আয়কর দিতে হবে,
১১. করদাতা যদি আয়কর পেশাজীবি হিসেবে জাতীয় রাজন্ব বোর্ডে নিবন্ধিত হন,
১২. করদাতা যদি কোন ব্যবসায়িক সং¯’ার সদস্য হন,
১৩. কেউ যদি সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদে কিংবা সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী হন,
১৪. করদাতা যদি কোন সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত কিংবা ¯’ানীয় সরকারের কোন টেন্ডার ক্রয়ে আগ্রহী হন,
১৫. করদাতার যদি বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স থাকে,
১৬. তবে কেউ যদি শুধু ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড নিতে কিংবা জমি বিক্রয়ের জন্য টিআইএন নিয়ে থাকেন তাদেরকে কোন রিটার্ন সাবমিট করতে হবে না।

করমুক্ত আয়ের খাতসমূহ:
যেহেতু পূবের্ই আমি বলেছি যে কর বর্ষে একজন করদাতা তার আয়ের উপর সরকারকে কর প্রদান করবেন। কিš‘ একটি মজার বিষয় হ”েছ যে সকল আয় কিš‘ করযোগ্য না, বরং কিছু কিছু আয় আছে যেগুলো করমুক্ত। চলুন জেনে নেয়া যাক সেসব আয় সম্পর্কে:
১. সরকারি কর্মকর্তাগন চাকরির দায়িত্ব পালনের জন্য যদি কোন সরকারি ভাতা বা আনুতোষিক পান,
২. সরকারি বা অনুমোদিত পেনশন,
৩. স্বীকৃত কোন প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থ,
৪. ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত সরকারি বা অনুমোদিত গ্র্যাচুইটি প্রাপ্তি হলে,
৫. স্বীকৃত সুপার এ্যানুয়েশন ফান্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থ,
৬. মিউচুয়াল ফান্ড বা ইউনিট ফান্ড থেকে ২৫,০০০ টাকা পর্যন্ত প্রাপ্ত মুনাফা বা ডিভিডেন্ড,
৭. শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোন কোম্পানি থেকে লভ্যাংশ বাবদ ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত আয়,
৮. ২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত ওয়ার্কার্স পার্টিসিপেশন ফান্ড থেকে ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত আয়,
৯. আয়ের একমাত্র উৎস যদি কৃষি কাজ হলে মোট আয়ের ২,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত,
১০. করদাতা যদি হাস-মুরগির খামারের মালিক হন তাহলে অর্জিত আয়ের প্রথম ২০,০০,০০০/= টাকা পর্যন্ত শূন্য হারে এবং পরবর্তী ১০ লাখ টাকার উপর ৫% হারে এবং পরবর্তী অবশিষ্ট টাকার উপর ১০% হারে কর প্রদেয় হবে,
১১. জিরো কুপন বন্ড থেকে অর্জিত আয়,
১২. হস্তশিল্পজাত দ্রব্যাদি রপ্তানি থেকে অর্জিত আয়,
১৩. সঞ্চয়পত্র থেকে প্রাপ্ত আয়,
১৪. মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাস্ট থেকে প্রাপ্ত সম্মানী বা ভাতা,
১৫. সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত কোন পুরষ্কার,
১৬. বৃদ্ধাশ্রম থেকে প্রাপ্ত আয়।
কখন দেবেন আয়কর রিটার্ন?
প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও ৩০শে নভেম্বর সারাদেশব্যাপি জাতীয় আয়কর দিবস পালিত হবে। যদিও গত বছর করোনা মহামারির কারনে রিটার্ন জমাদানের মেয়াদ এক মাস বর্ধিত করা হয়েছিল, কিš‘ এবছর এসংক্রান্ত কোন নির্দেশনা এখন পর্যন্ত আসে নি। করোনা মহামারির কারনে এবছরও আয়কর মেলা বন্ধ রয়েছে। কিš‘ সম্মানিত করদাতাগন স্ব স্ব কর অঞ্চলে গিয়ে মেলার মত করে কর জমা দিয়ে আসতে পারবেন। পুরনো করদাতাগন তাদের নিজন্ব কর অঞ্চলেই আয়কর জমা দিবেন, আর নতুন করদাতাগন ১২ ডিজিটের কর সনাক্তকরন নম্বর খুলে চাকরি¯’ল বা ব্যবসায়ের ঠিকানা ভিত্তিতে নিধারিত কর অঞ্চলে আয়কর প্রদান করবেন। তবে কোন করদাতা বিশেষ প্রয়োজন মনে করলে উপ-কর কমিশনারের বরাবর সময় বৃদ্ধির আবেদন করতে পারেন।

আয়কর রিটার্ন জমা না দিলে কি হবে?
যেহেতু আগেই বলেছি, কারোর যদি বাৎসরিক আয় আয়করের মিনিমাম লেভেলকে অতিক্রম করে তাহলে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে কর দিতে হবেই। কিš‘ কেউ যদি স্বে”ছায় আয়কর রিটার্ন জমা না দেন তাহলে আয়কর অধ্যাদেশের ১২৪ নং ধারা অনুযায়ী ৫০% অতিরিক্ত সুদ এবং ৭৩ নং ধারা অনুযায়ী বিলম্ব সুদ ধার্য করা হবে। তবে যথা সময়ে রিটার্ন জমা না দিলে পরবর্তীতে নানা জটিলতায় পরতে হয়। তাই অনাকাঙ্খিত বিড়ম্বনা এড়াবার জন্য নির্দিষ্ট সময়েই আয়কর রিটার্ন জমা দেয়া করদাতাগনের জন্য সুবিধাজনক।

পরিশেষে, প্রতি বছর যে পরিমানে কর আদায়ের টার্গেট নির্ধারন করা হয় তার অর্ধেকই আদায় হয় না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এক জরিপে দেখিয়েছে যে দেশে কর দেবার যোগ্য এমন মানুষের সংখ্যা ৮০ লাখের কম নয় । যদিও দেশে বর্তমানে ৪০ লাখ এর মত টিআইএন আছে, কিš‘ প্রতি বছর মাত্র ২২ লাখ করদাতা আয়কর প্রদান করে। তাহলে দেখা যা”েছ দেশের বিশাল একটা অংশ কর দেয়া থেকে বিরত থাকছে। এই বিশাল সংখ্যক মানুষ যে আয়করের বাইরে থেকে যা”েছন, তার ফলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেমন একদিকে অর্থ সংকট দেখা দি”েছ তেমনি ভাবে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হতে হ”েছ। আর যেই ২২ লাখ করদাতা কর প্রদান করে, তাদের মাঝেও অনেকেই প্রকৃত তথ্য গোপন করে কম কর প্রদান করে। ফলে সরকার প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হয়। খোদ অর্থ মন্ত্রনালয় থেকে একটি গবেষনায় দেখা গেছে দেশের অর্থনীতির ৪৫-৬৫ ভাগ অর্থ করের বাইরে, মানে কালো টাকা হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। সরকার প্রতি বছর যেই বড় বড় মেগা প্রজেক্টগুলো হাতে নি”েছ এগুলো কিš‘ আমার-আপনার করের টাকা দিয়েই নির্মিত হয়। আমরা যদি কর ফাঁকি দেই তাহলে আমরা নিজেরাই ক্ষতিগ্র¯’ হব। আর কর দেয়ার বিষয়ে সাধারন মানুষ ও ব্যবসায়ি উভয়েরই এক প্রকার ভীতি কাজ করে। তাই আয়কর নিয়ে আরো বেশি প্রচারনা চালাতে হবে, সাধারন মানুষের মাঝে আয়কর সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে তথা আয়করকে সাধারন মানুষের কাছে সহজবোধ্য করে তুলতে হরে। নতুন করদাতা তৈরির পাশাপাশি কর ফাঁকি রোধ করতে হবে। আয়কর বিভাগকে ডিজিটালাইজড করতে হবে। সর্বোপরি কর দেয়া যে একজন সুনাগরিকের দায়িত্ব সেটা মানুষকে অবহিত করা এবং করের টাকা কিভাবে ব্যবহার করা হ”েছ এ সম্পর্কে স্ব”ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখত: আয়কর আইনজীবি ও সহযোগী সদস্য, দি ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অফ বাংলাদেশ (আইসিএসবি)

Please Share This Post in Your Social Media

এই বিভাগের আরো সংবাদ
© ২০২০ দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি