রেমিট্যান্স প্রবাহে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় বছর শুরু হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ১৭০ কোটি ৪৪ লাখ (১.৭০ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাঙালিরা। সেই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৭ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২২ সালের প্রথম দিন থেকেই সরকার রেমিট্যান্স প্রবাহে নগদ প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে। তারই ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে এই সূচকে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙা হওয়ায় ওই সব দেশ থেকে বেশি রেমিট্যান্স আসছে বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রণোদনা বেড়েছে। সামনে দুটি ঈদ উৎসব আছে। সবকিছু মিলিয়ে আগামী দিনগুলোয় রেমিট্যান্স বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।’
প্রতিবেদনে দেখা যায়, টানা পাঁচ মাস কমার পর ডিসেম্বরে কিছুটা বেড়েছিল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে সেই বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ১৭০ কোটি ৪৪ লাখ (১.৭০ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১৪ হাজার ৬৫৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এর আগের মাস ডিসেম্বরে ছিল ১৬৩ কোটি ডলার। ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে ৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স বেশি আসলেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তা বেশ কিছুটা কম। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে ২৬ কোটি ডলার। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ১৯৬ কোটি ১৯ লাখ ডলার পঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, জানুয়ারিতে যে রেমিট্যান্স দেশে এসেছে, তার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩১ কোটি ১৩ লাখ ৪০ হাজার ডলার। বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩ কোটি ২ লাখ ডলার। ৪২টি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১৩৫ কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার ডলার। আর পাঁচটি বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৮৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার।
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ার সময় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল মহামারি। আশঙ্কা করা হয়েছিল, প্রবাসী আয়ে ভাটা পড়বে। কিন্তু অবিশ্বাস্য উত্থানে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে চাপ পড়তে দেননি। টানা দেড় বছর বাড়ার পর গত বছরের জুলাই থেকে ক্রগামত কমতে থাকে রেমিট্যান্স। তবে বছরের শেষ পাঁচ মাস ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির পরও ২০২১ সালে ২ হাজার ২০৭ কোটি (২২.০৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছিল বাংলাদেশ, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ।
এর আগে এক বছরে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০ সালে, ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে এসেছিল ১৮ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার।
অর্থবছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ১ হাজার ১৯৪ কোটি ৪০ লাখ (১১.৯৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ হাজার ২৯৪ কোটি ডলার। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বা ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর রেমিট্যান্স প্রবাহেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ওই বছরের এপ্রিলে মাত্র ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। মে মাসে তা বেড়ে ১৫০ কোটি ৪৬ লাখ ডলারে ওঠে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার।
মহামারির মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরোটা সময়ে (২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন) রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন লক্ষ করা যায়। ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
গত অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটার টান লক্ষ করা যায়। প্রথম মাস জুলাইয়ে আসে ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আগস্টে আসে ১৮১ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে আসে ১৭২ কোটি ৬২ লাখ ডলার। অক্টোবরে আসে ১৬৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। নভেম্বরে আসে আরও কম, ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। তবে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে তা কিছুটা বেড়ে ১৬৩ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। সর্বশেষ জানুয়ারিতে এসেছে ১৭০ কোটি ৪৪ লাখ ডলার।
প্রসঙ্গত, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিয়ে আসছিল সরকার। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তা বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে।