ভয়াবহ দরপতনের মধ্যে পড়েছে দেশের শেয়ারবাজার। প্রায় চার মাস ধরে শেয়ারবাজারে দরপতন চললেও সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করলে পতনের মাত্রা আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। ফলে প্রতিদিনই পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। নিয়মিত পুঁজি হারানো এসব বিনিয়োগকারীদের নীরব রক্তক্ষরণ বেড়েই চলেছে।
বড় ধরনের পতনের মধ্যে পড়ে গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন ১১ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা কমে যায়। তার আগের দুই সপ্তাহেও শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়। এতে তিন সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার মূলধন ২৮ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা কমে যায়।
এ পরিস্থিতিতে রোববার (৬ মার্চ) শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হয় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার মাধ্যমে। ফলে লেনদেন শুরুর ৬ মিনিটের মাথায় ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ১৫ পয়েন্ট বেড়ে যায়।
লেনদেনের শুরুতে দেখা দেওয়া এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। লেনদেনের সময় ২০ মিনিট পার হওয়ার আগেই সূচক ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। আর প্রথম ঘণ্টার লেনদেন শেষ হওয়ার পর বাড়তে থাকে পতনের মাত্রা। যা অব্যাহত থাকে লেনদেনের শেষ পর্যন্ত। ফলে সবকটি সূচকের বড় পতন দিয়ে লেনদেন শেষ হয়।
দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে ৯৮টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২৪৭টির এবং ৩৫টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
এতে দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৫৭ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৬৩৮ পয়েন্টে নেমে গেছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক আগের দিনের তুলনায় ১০ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৪৩১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আর বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক ২৪ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ৪৩৮ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
দিনভার ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৬৫১ কোটি ৫৬ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয় ৬৪৪ কোটি ৫৫ টাকা। সে হিসেবে লেনদেন বেড়েছে ৭ কোটি ১ লাখ টাকা। অবশ্য আগের কার্যদিবসে গত বছরের ১৮ এপ্রিলের পর সর্বনিম্ন লেনদেনের ঘটনা ঘটে।
ডিএসইতে টাকার অংকে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকোর শেয়ার। কোম্পানিটির ৭০ কোটি ৮৭ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ফরচুন সুজের ৬৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ২১ কোটি ৮৭ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো।
এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, সোনালী পেপার, কেয়া কসমেটিকস, রেনেটা লিমিডেট, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ওরিয়ন ফার্মা এবং কুইন সাউথ টেক্সটাইল।
অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ১২৭ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ১৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেওয়া ২৭৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮৫টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৫৮টির এবং ৩১টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, শেয়ারবাজারে এ দরপতনের ধারা শুরু হয় গত বছরের অক্টোবর থেকে। ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক এবং পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মধ্যে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা নিয়ে মতবিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় এ দরপতন। পরবর্তী সময় নভেম্বর অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির সম্পদ ও দায়ের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিঠি দেওয়া হলে পতনের মাত্রা আরও বাড়ে। যা চলে ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এরপর চলতি বছরের শুরুর দিকে পতনের মাত্রা কিছুটা কমে আসে। কিন্তু এর মধ্যেই গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করা নিয়ে বাজারে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আবারও টানা বড় দরপতনের মধ্যে পড়েছে শেয়ারবাজার।
রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার পর দেশের শেয়ারবাজারে এখনো পর্যন্ত সাত কার্যদিবস লেনদেন হয়েছে। এ সাত কার্যদিবসে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমেছে ৩১০ পয়েন্ট। বাজার মূলধন কমেছে ২৪ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ১১ মাসের মধ্যে ডিএসইতে সর্বনিম্ন লেনদেন হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
অবশ্য রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের শেয়ারবাজারে এমন দরপতন হওয়াকে অস্বাভাবিক বলছেন বিশেষজ্ঞরা। পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারে এখন যে দরপতন হচ্ছে তার যুক্তিসংগত কোনো কারণ নেই। কিন্তু এটাও সত্য আমাদের শেয়ারবাজার কোনো ব্যাকরণ মেনে চলে না। আমাদের বাজারের বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী না বুঝে বিনিয়োগ করে।
তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব আমাদের শেয়ারবাজার খুব একটা পড়ার কথা না। তবে মনস্তাত্ত্বিক একটা প্রভাব আছে। এ পরিস্থিতিতে কেউ পরিকল্পিতভাবে শেয়ারবাজারে দরপতন ঘটানোর চেষ্টা করছে কি না, তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির ক্ষতিয়ে দেখা উচিত। বাজারে একদিকে দরপতন হচ্ছে, অন্যদিকে বছরের পর বছর লভ্যাংশ দেয় না ও লোকসানের মধ্যে রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম বাড়ছে। এটা কেন হচ্ছে?
সিরডাপের গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মাদ হেলাল উদ্দিন বলেন, বিশ্বের সব দেশেই ভুল নীতির কারণে বুদবুদ তৈরি হয়। ভুল পলিসির কারণে ২০১০ সালে বাংলাদেশেও বুদবুদ ও ধস তৈরি হয়েছিল। সম্ভবত এসব কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালার ক্ষেত্রে অতিরক্ষণশীল অবস্থানে থাকে, পুঁজিবাজারে সূচক একটু বাড়লেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। বাস্তবে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো তেমন কিছু নেই। বাজারে বেশিরভাগ শেয়ারের মূল্য এখনো যৌক্তিক পর্যায়ের নিচে। গত এক দশকের মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য বিষয় সমন্বয় করা হলে সূচক এমনিতেই সাড়ে ৭ হাজার থাকার কথা, দৈনিক গড় লেনদেন হওয়ার কথা ৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে।