হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু নিয়ে শুরু থেকেই গোলকধাঁধায় পড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একে একে ফাঁস হওয়া নিত্যনতুন তথ্য ভাবিয়ে তুলছে তাদের। প্রায় এক যুগ ধরে নাম পরিবর্তন করে দেশেই আত্মগোপনে ছিলেন পলাতক হারিছ চৌধুরী। এ তথ্য বেরিয়ে আসার পর চিন্তায় ফেলেছে পুলিশের বিভিন্ন সংস্থাকে। কীভাবে তিনি নাম পরিবর্তন করে জাতীয়পত্র নিলেন, কীভাবে হারিছ থেকে মাহমুদুর রহমান নামে পাসপোর্ট বানালেন, আর কীভাবেই বা সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি রাজধানীর পান্থপথে বসবাস করছিলেন বছরের পর বছর। পরিবর্তিত নামে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, মারা যাওয়ার পর ঢাকার কাছেই দাফন সম্পন্ন হলো। স্বজনরাও স্বীকার করেছেন এসব। ওই ব্যক্তিই হারিছ চৌধুরী কি না সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ। তাদের এখন একমাত্র ভরসা ডিএনএ পরীক্ষা।
এদিকে প্রয়াত পিতার পরিচয় সম্পর্কে দ্বিধা দূর করতে কবর থেকে লাশ তুলে তার ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন জানিয়ে লন্ডন প্রবাসী ব্যারিস্টার সামিরা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর চিঠি পাঠিয়েছেন বলে জানা গেছে। গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে এটা নিয়ে কাজ করছি। পত্রিকায় খবর এসেছে। লাশ ডিজেন্টার (মরদেহ উঠিয়ে নমুনা সংগ্রহ) করলে বা ডিএনএ টেস্ট করলে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানানো হবে।’ হারিছ চৌধুরীর স্বজনরা গণমাধ্যমকে বলেছেন, হারিছ চৌধুরীই তার নাম-পরিচয় গোপন করে মাহমুদুর রহমান সেজেছেন। ওই পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রও তৈরি করেন। ইন্টারপোলের রেড নোটিসধারী হারিছ সব গোয়েন্দার চোখে ধুলো দিয়ে এত দিন ঢাকায় অবস্থায় করছিলেন। জানা গেছে, গত বছর ৩ সেপ্টেম্বর হারিছ চৌধুরী ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে মারা যান। পরদিন মাহমুদুর রহমান পরিচয়ে হারিছকে ঢাকার সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের জালালাবাদের কমলাপুর এলাকায় জামিয়া খাতামুন্নাবিয়ীন মাদরাসার কবরস্থানে দাফন করা হয়। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়ায় আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলে তার নামে যে রেড ওয়ারেন্ট আছে, তা এখনো ঝুলছে। পলাতক হারিছ চৌধুরী জীবিত না মৃত তা নিশ্চিত হতে তদন্তে মাঠে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সংস্থাটির সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগ ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত আসামি হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। তার মেয়েকে উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমে খবরও বেরিয়েছে। এর পরই বিষয়টি নিশ্চিত হতে পুলিশ সদর দফতর থেকে সিআইডিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সিআইডি সূত্র জানায়, ১৯ জানুয়ারি হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু নিশ্চিত হতে সিআইডিকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। এরপর ২৫ জানুয়ারি সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সিরিয়াস ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান খান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমি কিছু বলতে পারব না। আমার কোনো বক্তব্য নেই। তার পরিবার সব জানে। তাদের সঙ্গে আপনারা যোগাযোগ করুন।’ তবে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু ও পরিচয় নিশ্চিত হতে তদন্ত এখনো চলছে। গতকালও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে আত্মগোপনে চলে যান হারিছ চৌধুরী। এর পর থেকে তাকে ধরিয়ে দিতে ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারি করা হয়। ১৪ বছর ধরে এই নোটিস ঝুললেও তার অবস্থানের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না বা তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) সূত্র জানায়, হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন গণমাধ্যমে এ ধরনের খবর তাদের নজরে আসে। এর পরই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সিআইডিকে চিঠি দেওয়া হয়। এ ছাড়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাটি তদন্ত করেছিল সিআইডি। ওই সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হারিছ চৌধুরীসহ ওই মামলার পলাতক কয়েকজন আসামির বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারির আবেদন করা হয় ইন্টারপোলে। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি যাচাই-বাছাই শেষে এই নোটিস তাদের ওয়েবসাইটে দেয়। এখন তদন্ত শেষে সিআইডি যদি ওই আসামির মৃত্যু হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে, তাহলে ওই নোটিস সরানোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। গতকাল ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে গিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন অপরাধে পলাতক বাংলাদেশের রেড নোটিসধারী ৬৩ জনের মধ্যে হারিছ চৌধুরীর নাম ও ছবি ১৬ নম্বরে রয়েছে। সেখানে তার নাম চৌধুরী আবুল হারিছ লেখা রয়েছে। এতে তার জন্মতারিখ থেকে শুরু করে জন্মস্থান, জাতীয়তা, উচ্চতা, ওজন, চুল ও চোখের রংসহ শারীরিক বিবরণ রয়েছে। রেড নোটিসে তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যাকান্ডের কথা উল্লেখ রয়েছে।