রাজধানীর শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ। সাতক্ষীরা সীমান্ত এলাকা থেকে তাঁকে আটক করা হয়। তিনি ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে পুলিশ ধারণা করছে।
গতকাল বিকেলে তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ মিলেছে, আটক তরুণের গুলিতে টিপু নিহত হন।
আরো দুজনকে ধরার চেষ্টা করছে পুলিশ। তাঁরা ঘটনার মূল পরিকল্পনায় ছিলেন। পেশাদার একটি ‘কিলার’ গ্রুপ এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। সবাইকে আটকের পর সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানানো হবে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আটক ওই তরুণ মূলত ভাড়াটে খুনি। মতিঝিল এলাকার বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার ঘনিষ্ঠ এই তরুণসহ অন্তত পাঁচ থেকে সাতজন এই হত্যাকাণ্ডে পরোক্ষভাবে জড়িত থাকতে পারেন। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব শুরু হলে তাঁদের টাকার বিনিময়ে ভাড়া করা হয়।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানতে পেরেছেন, এঁরা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিকের ঘনিষ্ঠ এবং শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ক্যাডার বাহিনীর সদস্য। এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এঁদের ব্যবহার করা হয়। মতিঝিল এলাকায় এঁদের মতো অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী রয়েছে। এর আগে এঁদের হাতে আরো অনেকে খুন হন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আটক যুবক ২০১৬ সালে মতিঝিল এলাকায় যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোঁচা বাবু হত্যাকাণ্ডেও জড়িত ছিলেন। বোঁচা বাবু হত্যা মামলায় এই যুবকসহ ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করা হয়। বোঁচা বাবুর বাবা টিপুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সম্প্রতি ওই মামলা নিয়ে নতুন করে টিপুর সঙ্গে একজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার কিছু বিরোধ তৈরি হয়। তিনি ওই মামলার এক আসামির নাম বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেন। এতে বাধা দেন টিপু। বিষয়টি নিয়ে ওই নেতা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিকের সঙ্গে কথা বলেন। এই শীর্ষ সন্ত্রাসীরা টিপুকে ফোন করে ওই নেতার নাম বাদ দিতে বললেও টিপু রাজি হননি। তিনি মামলা চালাতে বোঁচা বাবুর পরিবারকে সহযোগিতা করেন। এসবই টিপুর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
সূত্র জানায়, মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে বোঁচা বাবু হত্যা মামলা নিয়ে আসামিদের সঙ্গে আপস না করায় স্থানীয় রাজনীতিবিদদের একটি অংশের সঙ্গে সম্প্রতি টিপুর চরম বিরোধ তৈরি হয়।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ধারণা, টিপু হত্যাকাণ্ডে আরো কিছু কারণ থাকতে পারে। ২০১৩ সালে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক মিল্কি হত্যা, ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ে বিরোধ, তিনটি বাজারকেন্দ্রিক চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে বাধা, এলাকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব, এজিবি কলোনিতে দলীয় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিরোধে টিপুকে হত্যা করা হতে পারে।
সূত্র জানায়, মতিঝিল এলাকার বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে এরই মধ্যে র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আরো বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা চলছে।
ঘটনাস্থল থেকে জব্দ সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বুকের সামনে ব্যাগ আর হেলমেট পরা এক যুবক মোটরসাইকেল থেকে নেমেই মাইক্রোবাসের সামনের সিটে বসা টিপুর গাড়িতে গুলি চালান। গুলিতে গাড়ির কাচ ভেঙে যায়। টিপুকে লক্ষ্য করে দ্রুত গুলি চালিয়ে সড়কের অন্য পাশ দিয়ে পালিয়ে যান ওই যুবক। তখন সড়কে টিপুর গাড়ির বিপরীত পাশের মার্কেট বন্ধ ছিল। রাস্তাও ছিল ফাঁকা। ফলে গুলির পরপরই দ্রুত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন খুনি।
গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর শাহজাহানপুরে ইসলামী ব্যাংকের পাশে বাটার শোরুমের সামনে আওয়ামী লীগ নেতা টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা সামিয়া আফরান প্রীতি নামের এক কলেজছাত্রীও নিহত হন। তবে ওই কলেজছাত্রী সন্ত্রাসীদের গুলিতে, নাকি অন্য কারো গুলিতে নিহত হয়েছেন, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। এ ছাড়া টিপুর গাড়িচালক মুন্নাও গুলিবিদ্ধ হন।
এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতেই শাহজাহানপুর থানায় নিহত টিপুর স্ত্রী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংরক্ষিত কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টিপুর হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবি, র্যাব, সিআইডি ও পিবিআই কাজ করছে। হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা গুলির খোসাসহ ফরেনসিক আলামত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান শামীম বলেন, দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় টিপুকে হত্যা করা হয় বলে প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে। তদন্তে অনেক অগ্রগতি আছে। নানা দিক মাথায় রেখে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চলছে। খুনিরা তাঁদের নাগালের মধ্যেই আছে। অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে শিগগিরই সুখবর জানানো হবে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ব্যাপক গোয়েন্দা তৎপরতায় সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।
কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
গতকাল সকালে টিপু হত্যার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, টিপু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চলছে। এর পেছনে কারা, নাটের গুরু কারা, কারা ঘটিয়েছে—সব কিছুই খোলাসা করে দেশবাসীকে জানানো হবে। তবে যারাই এ ঘটনায় জড়িত থাকুক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।