যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক খুচরা বিক্রেতা ব্র্যান্ড সিয়ার্সের বিরুদ্ধে মামলা করে ৫০ লাখ ডলার বা ৪২ কোটি ৫০ লাখ টাকা বুঝে পেয়েছে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের ১৩ শিল্পগোষ্ঠী। তবে ব্র্যান্ডটির কাছে তাদের আরও পাওনা রয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার, দেশীয় মুদ্রায় যা ৩০৮ কোটি টাকার সমান।
জানা যায়, করোনার আগে সিয়ার্সের ক্রয়াদেশ অনুযায়ী ২ কোটি ২৭ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করে ১৩ শিল্পগোষ্ঠী। সেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক বন্দরে পড়ে ছিল। ১ কোটি ১৯ লাখ ডলারের পোশাক পড়ে ছিল প্রতিষ্ঠানগুলোর গুদামে। তা ছাড়া সিয়ার্সের ক্রয়াদেশের বিপরীতে ৬৪ লাখ ডলারের কাঁচামাল কেনা ছিল। কোনো কিছুর দাম পরিশোধ না করায় ১৩ শিল্পগোষ্ঠী এক জোট হয়ে সারাচেক ল ফার্মের মাধ্যমে গত সেপ্টেম্বর মাসে সিয়ার্সের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট, সাউর্দান ডিস্ট্রিক্ট অব নিউইয়র্কে মামলা করে। এরপর সিয়ার্স কর্তৃপক্ষ আদালতের বাইরে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা করার প্রস্তাব দেয়।
সিয়ার্সের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সমঝোতা অনুযায়ী বন্দরে পড়ে থাকা ২ কোটি ২৭ লাখ ডলারের পোশাক বুঝে নেয় ব্র্যান্ডটি। বাংলাদেশের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে গত অক্টোবরে ৫০ লাখ ডলার পরিশোধ করে তারা। বিক্রয়কেন্দ্রে সেই পোশাক বিক্রির প্রথম ৫০ লাখ ডলার নেবে সিয়ার্স। এরপর যে বিক্রি হবে, তা ৫০ শতাংশ ব্র্যান্ড ও বাকি ৫০ শতাংশ বাংলাদেশি পোশাক কারখানা পাবে।
সিয়ার্সের বিরুদ্ধে মামলা ও তারপর সমঝোতার পুরো বিষয়টি দেখভাল করছেন পেট্রিয়ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেন। তিনি গতকাল বলেন, যেটুকু পণ্য সিয়ার্স বুঝে নিয়েছে, তার ৬৫ শতাংশ অর্থ পাওয়া যেতে পারে। শিগগিরই হয়তো ১৫ লাখ ডলার পাবে ১৩ শিল্পগোষ্ঠী।
ইকবাল হোসেন জানান, সিয়ার্সে পোশাক রপ্তানি করে নাসা, ব্যাবিলন, একেএইচ, এনভয়, অ্যাবা, মোহাম্মদী, পলমল, ক্রুডেন্ট ইন্টারন্যাশনাল, উইন্ডি, মেঘনা, অ্যাসোরটেক্স, পার্ল ও অ্যামট্রারনেট গ্রুপের ৩০ কারখানা বিপদে পড়েছে।
সিয়ার্সকে ১৪ লাখ ডলারের ডেনিম প্যান্ট রপ্তানি করেছিল এনভয় গ্রুপ। ইতিমধ্যে তারা ৪৯ শতাংশ অর্থ বুঝে পেয়েছে। তবে তাদের গুদামে সিয়ার্সের ২ লাখ ৩০ হাজার ডলারের পোশাক পড়ে আছে এখনো।
বিষয়টি নিশ্চিত করে এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, সিয়ার্সের ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। কিছু ব্র্যান্ড কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই ক্রয়াদেশের পণ্য নিতে চায় না। তাতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যে বড় ধরনের লোকসানে পড়ে যায়, সেটি তারা বুঝতে চায় না। তিনি আরও বলেন, সিয়ার্সের কাছ থেকে ৬০-৬৫ শতাংশের বেশি অর্থ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত সিয়ার্স আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ খুচরা বিক্রেতা ব্র্যান্ডে পরিণত হয়। তবে নব্বইয়ের দশকে বিক্রিতে সিয়ার্সকে ছাড়িয়ে যায় ওয়ালমার্ট ও কেমার্ট। টানা কয়েক বছর বিক্রি কমতে থাকার পর ২০১৮ সালে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করার জন্য আবেদন করে তারা। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে সিয়ার্সের মালিকানায় আসে আরেক মার্কিন কোম্পানি ট্রান্সফর্মকো। তাদের হাতে আরেক বিখ্যাত ব্র্যান্ড কেমার্টের মালিকানাও রয়েছে।
গত মার্চে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে করোনা ছড়িয়ে পড়লে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশ আসতে থাকে। তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, তখন প্রায় ৩১৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ প্রাথমিকভাবে বাতিল ও স্থগিত হয়। পরে নানামুখী চাপের কারণে অধিকাংশ ক্রেতাই পণ্য নিতে সম্মত হয়। তবে অর্থ পরিশোধে বেশ কয়েক মাস সময় চেয়েছে অনেক ক্রেতা ও ব্র্যান্ড। অনেক ক্ষেত্রে মূল্যছাড়ও দিতে হয়েছে উদ্যোক্তাদের।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘ব্যবসা করতে আসা বিদেশি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানকেও নীতি–নৈতিকতা মেনে চলতে হবে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করা ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ শুরু করেছি। সিয়ার্সের কাছে কিছু অর্থ উদ্ধার সেই যুদ্ধের ছোট সফলতা।