আমিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির (হেনোলাক্স) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ও পরিচালক ফাতেমা আমিন গায়ে আগুন দিয়ে নিহত গাজী আনিসকে তাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগের প্রলোভন দিয়েছিলেন। এরপর নিজের জমানো টাকা এবং আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে লভ্যাংশ দেওয়ার কথা বলে টাকা ঋণ করে এনে নুরুল আমিনকে দিয়েছিলেন তিনি। কয়েক মাস নির্দিষ্ট লভ্যাংশ দিলেও এরপর আর টাকা দেননি নুরুল আমিন। আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করায় তাদের টাকা পরিশোধের চাপে ছিলেন আনিস। এসব কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
আজ বুধবার (৬ জুলাই) দুপুরে র্যাবের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান।
এর আগে নিজ গায়ে আগুন দিয়ে গাজী আনিসের মৃত্যুকে আত্মহত্যায় প্রোরোচনার অভিযোগে করা মামলার ভিত্তিতে নুরুল আমিন ও ফাতেমা আমিনকে রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেফতার করে র্যাব।
গত ৪ জুলাই বিকালে জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায় গাজী আনিস নিজের গায়ে পেট্রোল জাতীয় দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। তার শরীরের ৯০ শতাংশ দগ্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৫ জুলাই ভোরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনায় তার ভাই নজরুল ইসলাম রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি আত্মহত্যা প্ররোচনার অভিযোগে মামলা করেন।
এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে আমিন গ্রুপের কর্ণধার মো. নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের সঙ্গে ভিকটিমের পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে আনিসের সখ্যতা ও আন্তরিকতা গড়ে ওঠে। গ্রেফতারকৃতরা ২০১৮ সালে চিকিৎসার জন্য পাশের একটি দেশে গেলে সেখানে স্থানীয় একটি আবাসিক হোটেলে একইসঙ্গে অবস্থানকালে ভিকটিমকে হেনোলাক্স কোম্পানিতে বিনিয়োগের জন্য প্ররোচিত করেন। ভিকটিম প্রথমে রাজি না থাকলেও পরে রাজি হন এবং প্রাথমিকভাবে ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। পরে তাদের প্ররোচণায় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ধার করে আরও ২৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। বিনিয়োগ করার সময় পরস্পরের প্রতি সম্মান এবং বিশ্বাসের কারণে তাদের মধ্যে কোনও চুক্তিনামা করা হয়নি। বিনিয়োগ-পরবর্তী চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তিপত্র সম্পাদন করার জন্য ভিকটিম বারবার আসামিদের অনুরোধ করেন। কিন্তু তারা গড়িমসি করতে থাকেন।
একপর্যায়ে আসামিরা প্রতিমাসে যে লভ্যাংশ দিতো সেটাও বন্ধ করে দেয় এবং কয়েকবার আসামিরা লোকজন দিয়ে ভিকটিমকে হেনস্তা ও ভয়ভীতি দেখায়। বর্তমানে লভ্যাংশসহ ভিকটিমের ন্যায্য পাওনা ৩ কোটি টাকার বেশি বলে জানা যায়। ওই টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ভিকটিম আসামিদের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়ার আদালতে দুটি মামলা দায়ের করেন। এছাড়া ওই টাকা ফিরে পাওয়ার জন্য ২৯ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেন। গত ৩১ মে তার ফেসবুক আইডি হতে পাওনা টাকা আদায় সংক্রান্তে মামলা দায়ের বিষয়টি পোস্ট করেন এবং বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে সহায়তা চান।
এজাহার সূত্রে আরও জানা যায়, ঘটনার দিন পাওনা টাকা পরিশোধের কথা ছিল। বিকালে আসামি ফোনে যোগাযোগ করলে হেনোলাক্সের মালিক টাকা না দেওয়ার কথা জানান। তাদের আচরণে হতাশ হয়ে রাগে-ক্ষোভে অভিমান করে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি।
র্যাব হেফাজতে হেনোলাক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তার স্ত্রীর্যাব হেফাজতে হেনোলাক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তার স্ত্রী
জানা যায়, ভিকটিম কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার পান্টি গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ঠিকাদারি ব্যবসার পাশাপাশি একটি টেলিকম কোম্পানিতে চাকরি করতেন। পরে চাকরি ছেড়ে কুষ্টিয়ায় গাড়ির ব্যবসা শুরু করেন। ভিকটিম সাহিত্য চর্চা করতেন এবং তার বেশ কয়েকটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে।
আরও জানা যায়, গ্রেফতারকৃত নুরুল আমিন ১৯৮১-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ঢাকার গোপীবাগ এলাকায় কাদের হোমিও হল নামে হোমিও হলে ১৫ বছর চাকরি করেন। ওই সময়ে তার একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠার কথা মাথায় এলে ১৯৯১ সালে হেনোল্যাক্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ব্যবসা শুরু করেন। পরে কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে আমিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি নাম দেন। ওই কোম্পানির অধীনে হেনোলাক্স কসমেটিকস্ যেমন: হেনোলাক্স কমপ্লেকশান ক্রিম, হেনোলাক্স স্পট ক্রিম, হেনোলাক্স মেছতা আউট ক্রিম ও হেনোলাক্স হেয়ার অয়েল ও পল্ট্রি ফার্মের ব্যবসা করেন।
পরে বাজারে হেনোলাক্সের চাহিদা কমে গেলে ২০০৯ সালে তিনি আমিন হারবাল নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন এবং ২০১৬ সালে হেনোলাক্সের ব্যবসা বন্ধ করে দেন। তাদের কাকরাইলে একটি ফ্ল্যাট, পুরানো পল্টনে স্কাই ভিউ হেনোলাক্স সেন্টার নামে একটি ১০ তলা ভবন, পিংক সিটিতে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি, মেরাজনগর কদমতলীতে হেনোলাক্স নামে ৪তলা ভবন, মোহাম্মদবাগ কদমতলী এলাকায় হেনোলাক্স ফ্যাক্টরি রয়েছে। বর্তমানে ওই ফ্যাক্টরিতে খান ফুড প্রোডাক্টস, বন্যা ফুড প্রোডাক্টস ও জেকে অ্যাগ্রো ফুড নামে তিনটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভাড়ায় তাদের উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে।
গ্রেফতারকৃত ফাতেমা আমিন একটি বেসরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ হতে ডিএইচএমএস সম্পন্ন করে তার স্বামীর আমিন হোমিও হলে প্রথমে ১ বছর হোমিও চিকিৎসা করেন। তিনি তার স্বামীর প্রতিষ্ঠিত আমিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি তার স্বামীর আমিন হারবাল কোম্পানির দেখাশোনা করেন।
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, নুরুল আমিন জানিয়েছেন, তিনি ৭৪ লাখ টাকা দিয়েছেন। চেক ও নগদ অর্থের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করেছেন। তবে ভিকটিম ও আসামিদের টাকার অংকে পার্থক্য রয়েছে। এ বিষয়টি কর্মকর্তারা তদন্ত করে দেখবেন।